আজ নব সূচনার দিন

বিগত দিনের অপ্রাপ্তি, আক্ষেপ সব ভুলে আজ নব সূচনার দিন। লোকায়ত জীবনের গভীর বোধ, শেকড়ের শক্তি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শান দেওয়ার শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। শুক্রবার ১৪৩০ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, বাঙালির পহেলা বৈশাখ।

কৃষকরা এইদিনে শুধু ফসল নয়, নতুন স্বপ্ন বুনবেন। ঐতিহ্য মেনে হালখাতা খুলবেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকাসহ সারাদেশে একযোগে চলবে বর্ষবরণের ঐতিহ্যবাহী উৎসব অনুষ্ঠান।

প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে বাঙালিত্বের সচেতন চর্চা ও উজ্জীবন চোখে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের জায়গা থেকে, অসাম্প্রদায়িক বোধ থেকে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। গত বছরের মতো এবারও রোজার মধ্যেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রস্তুতি পর্বে সাধারণ মানুষের সারা ছিল অভাবনীয়। একই কারণে রোজা রেখেই বর্ষবরণ উৎসবে মাতবে বাঙালি। বাংলা সনের প্রথম দিন সব ধর্মবর্ণের মানুষ ভেদাভেদ ভুলে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হবে। সকলে মিলে সমান আনন্দ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উদ্যাপন করবে বাংলা নববর্ষ।

আলাদা আলাদা মঞ্চ থেকে গ্রামীণ জীবন ও শেকড়ের সংস্কৃতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হবে। বরাবরের মতোই ছায়ানটের সঙ্গে রমনা বটমূলে বছরের প্রথম দিনটি শুরু করবে রাজধানীবাসী। তার পর পরই চারুকলা অনুষদ থেকে বের করা হবে সবচেয়ে বর্ণিল আয়োজন- মঙ্গল শোভাযাত্রা।

তবে এবার এমন এক সময়ে বর্ষবরণ উৎসব অনুষ্ঠিত হবে যখন ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী ভয় দেখিয়ে বাঙালিকে রুখার সেই পুরনো খেলায় মেতে উঠেছে। চোখ রাঙাচ্ছে ভিনদেশী শকুন। প্রগতি বিরোধী অপশক্তির সঙ্গে অবলীলায় হাত মেলাচ্ছে প্রগতিশীল রাজনীতিরই একটি অংশ।

ফলে আজ শুধু উৎসব নয়। বাঙালিত্বের গৌরব নিয়ে নিজস্বতা নিয়ে বাঁচার, এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় শপথ গ্রহণের দিন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক কৃষির। এ সম্পর্কের সূত্রেই বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। কে প্রবর্তন করেছিলেন বা কীভাবে হয়েছিল তা নিয়ে অমত, দ্বিমত আছে। একটি মত অনুযায়ী, স¤্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। এখন যা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত। বঙ্গাব্দের মাস হিসেবে বৈশাখের প্রথম স্থান অধিকার করার ইতিহাসটি বেশিদিনের না হলেও, আদি সাহিত্যে বৈশাখের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।

দক্ষের ২৭ কন্যার মধ্যে অনন্য সুন্দরী অথচ খরতাপময় মেজাজসম্পন্ন একজনের নাম ছিল বিশাখা। এই বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারেই বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখের নামকরণ করা হয়। বৈদিক যুগে সৌরমতে বৎসর গণনার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সেখানেও সন্ধান মেলে বৈশাখের।

আবহমানকাল ধরেই চলছে বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। আদিতে বর্ষবরণের মূল আচার-অনুষ্ঠান হতো গ্রামে। এখনো বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে বাড়িঘর ধুয়েমুছে পরিষ্কার করেন গৃহিণীরা। ঘরের মেঝেতে আল্পনা আঁকা হয়। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন সবাই। স্নান সারেন। নতুন পোশাক পরেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যান। ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। থাকে পিঠা-পুলির আয়োজন। হাটে-মাঠে-ঘাটে বসে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। নানা রকম কুটিরশিল্প, খেলনা, মিষ্টিসহ বাহারি পণ্যে স্টল সাজানো হয়।

বিভিন্ন এলাকায় আয়োজন করা হয় নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা কিংবা কুস্তির মতো ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার। বর্তমানকালে অবশ্য অনেক কিছুই বদলে গেছে। তবে ঐতিহ্যের প্রতি টান হৃদয় দিয়ে অনুভব করে বাঙালি। নাগরিক জীবনেও বিপুল আনন্দ যোগ করে পহেলা বৈশাখ। বর্ষবরণের দিন দেশের প্রায় সব শহরেই আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য উৎসব অনুষ্ঠানের। ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর। আজও নূতনের জয়ধ্বনি করবে গোটা দেশ।

ষাটের দশকে পাকিস্তানীদের বিরোধীতার মুখে ঢাকার রমনা বটমূলে শুরু হয় পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন। এর মাধ্যমে বাঙালি আপন পরিচয়ে সামনে আসার সুযোগ পায়। পরবর্তীতে বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিশেষ উত্থান ঘটে পহেলা বৈশাখের। নববর্ষের প্রথম দিনটি বর্তমানে বাঙালির জাতিসত্তায়, চেতনায় ও অনুভবের জগতে গভীরভাবে বিরাজ করছে।

এসএইচ-০১/১৪/২৩ (অনলাইন ডেস্ক)