নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচির চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিস্থিতি তৈরি করছে বিএনপি

আন্দোলনের গতি ফেরাতে পথ খুঁজছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দল এবং জোটের মধ্যে চলমান ঐক্য ধরে রেখে রাজপথে আরও বেশ কিছু দিন নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি চালিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিস্থিতি তৈরি করাই হচ্ছে দলের মূল পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে করণীয় ঠিক করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা। গত বুধবার সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন তারেক রহমান। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে আগামী কয়েক দিন ধারাবাহিক বৈঠক হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রাস্তার আন্দোলন ছাড়া কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকার নিজে থেকে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না। চলমান সংকটের সমাধানও রাস্তায় করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচিও দেওয়া হবে।

দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, গত বছর রাজধানী ঢাকার বাইরে এককভাবে বিভাগীয় সমাবেশ করে আন্দোলনের গতি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল বিএনপি। ওই আন্দোলনের কারণে দীর্ঘদিন পর নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মাঝে বড় ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। নেতাকর্মীদের বক্তব্য-বিবৃতিতে এসেছিল বড় পরিবর্তন। কয়েকজন নেতা ঢাকা সমাবেশে সরকারকে প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি দেন। কিন্তু নয়াপল্টনে পুলিশ ও বিএনপির সংঘর্ষ, হতাহত, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশের অভিযান ও গ্রেপ্তারের পর আন্দোলনের গতি নিচের দিকে নামতে থাকে। যার প্রমাণ গত বছর ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় সমাবেশেও পাওয়া যায়। ওই সমাবেশ থেকে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা ছাড়াও জাতীয় সংসদ থেকে দলীয় এমপিরা পদত্যাগের মতো ঘোষণা দেন।

দলের নেতারা মনে করেন, যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা ও দলীয় এমপিদের পদত্যাগ- এটি ছিল ওই সমাবেশের বড় সফলতা। কিন্তু ৭ ডিসেম্বরের ঘটনায় নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে যায়।

সংসদ বিলুপ্ত, সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকার, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনসহ ১০ দফা দাবিতে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের গতি বাড়াতে ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, উপজেলা বা পৌরসভা, জেলা-মহানগরে নিয়মতান্ত্রিক সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, গণপদযাত্রা ও লিফলেট বিতরণসহ ইত্যাদি নানা কর্মসূচিও পালন করে দলটি।

বিগত বছরগুলোতে রমজানে রাজনৈতিক কর্মসূচি রাখত না বিএনপি; এবার রাজপথে কর্মসূচি পালন করেছে। শুধু তাই নয়, এবারের ঈদের দিন থেকে তিন দিনও কর্মসূচি করেছে। কিন্তু কোনো অবস্থায় আন্দোলনের প্রত্যাশিত গতি আনতে পারছে না দলটি।

দলের একাধিক নেতা বলেন, ‘রাজপথে এসব কর্মসূচি করেও আন্দোলনের কাক্সিক্ষত গতি আনা সম্ভব হয়নি- এ কথা সত্য। কিন্তু দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা বসে নেই। আন্দোলনের গতি ফেরাতে তারা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^রচন্দ্র রায় বলেন, আন্দোলন কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়, আবার কখনো কখনো স্বল্প সময়ের মধ্যে বিজয় লাভ করে। কোন সরকার কবে যাবে, সেটি নির্ধারিত নয়; এটি নিশ্চিত যে ফ্যাসিবাদের পতন অনিবার্য। এটি করবে দেশের জনগণ। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই সরকারের বিদায় ঘটানো হবে।’

অহিংস পথে আন্দোলনের গতি কীভাবে চূড়ান্ত অবস্থায় নেওয়া যায় তা নিয়ে গত বুধবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন তারেক রহমান। এই বৈঠকে সাংগঠনিক সম্পাদকরা তাদের নিজ নিজ পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তবে তারা এ-ও বলেন, আবেগ দিয়ে নয়, বাস্তবতার নিরিখে চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দিতে হবে। কোনো কোনো নেতা নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করে সেপ্টেম্বরে চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দেওয়ারও প্রস্তাব দেন। এ সময় আসন্ন পাঁচ সিটি নির্বাচন বিষয়ে কথা উঠলে সবাই একবাক্যে মতামত দেন। যারা এই নির্বাচনে যাবে তাদের আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। পাশাপাশি সিটি নির্বাচন চলাকালে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়।

দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা জানান, দলের নীতিনির্ধারকরা চান চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দল ও জোট নেতাদের মধ্যে ঐক্য অটুট রাখতে। গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায়ও বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, যুগপৎ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচিসহ চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মপন্থা তৈরিতে সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট নেতাদের সঙ্গে কথা বলা হবে। এ জন্য যুগপৎ আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা বলেন, সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করবে আগামী দিনে যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি কোন পথে যাবে।

দলীয় নেতাদের সূত্রে জানা যায়, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত এবং সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ভার্চুয়ালি বৈঠকের মতামত নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হবে এবং তাতে নতুন কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে। তবে স্থায়ী কমিটি ৩০ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখেই কর্মসূচি প্রস্তুত করবে। সে ক্ষেত্রে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আবার যুগপৎ কর্মসূচি শুরু হতে পারে।

কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলা, মহানগর বা বিভাগীয় পর্যায়ে বড় সমাবেশ, মানববন্ধন অথবা অবস্থান কর্মসূচি দিয়ে এর শুরু হতে পারে। এর পর আন্তঃজেলা বা বিভাগে রোডমার্চের মতো যুগপৎ কর্মসূচি আসতে পারে। বৃহত্তর ১৯ জেলায় সমাবেশ করে সর্বশেষ ঢাকায় বড় সমাবেশ করারও প্রস্তাব রয়েছে।

যুগপৎ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি শুরু করার আগে বেশ কিছু কর্মসূচি করবে বিএনপি। এর মধ্যে ৩০ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই) বিএনপির নেতাদের নিয়ে কর্মশালা করবে। ডিআই বাংলাদেশের বড় দলগুলোর নেতাদের নিয়ে আলাদাভাবে এ ধরনের কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে শ্রমিক দলের ব্যানারে নয়াপল্টনে বড় সমাবেশ এবং সেখান থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত শোভাযাত্রা করবে। ৫ মে জলবায়ুবিষয়ক সেমিনার কর্মসূচি রয়েছে দলটির।

এসএইচ-০১/২৮/২৩ (অনলাইন ডেস্ক)