বিএনপির আন্দোলনের শুরুতে থাকবে না হরতাল-অবরোধ

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে এক দফা দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এ আন্দোলনের শুরুতে থাকবে না হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি এখন কার্যকর নয়। এ ধরনের কর্মসূচিতে জনসম্পৃক্ততা মেলে না; জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হওয়ায় মানুষ উল্টো বিরক্ত হয়। তাই সহিংস কর্মসূচি এড়িয়ে চলতে চায় দলটি।

নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে তারা এক দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করবে। ধাপে ধাপে আন্দোলনকে নেওয়া হবে চূড়ান্ত পর্যায়ে।

শনিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বুধবার বিকাল ৩টায় ঢাকার নয়াপল্টনে সমাবেশের মাধ্যমে এক দফা ঘোষণা করবে বিএনপি। একই দিনে একই দাবিতে আলাদা কর্মসূচি ঘোষণা করবে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও জোট।

সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের ১০ দফার সঙ্গে অন্যান্য দলের দফা সমন্বয় করে এক দফা আন্দোলনে যাব। সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন

এবং নতুন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান- এসব দাবিতে আমরা একটা জায়গায় আসছি। আর সেটা মূলত এই সরকারের পদত্যাগ।

ফখরুল জানান, এবারের আন্দোলনের ধরন একটু ভিন্ন হবে এবং জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়বে। হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে সচেতনভাবে যাচ্ছি না। সরকার সহিংস আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিলে তার দায় সরকারের। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছি, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে চাই।

যুগপৎ আন্দোলনে থাকা একাধিক দল ও জোট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী বুধবার বেলা ১১টার দিকে গণতন্ত্র মঞ্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। ১২ দলীয় জোট সংবাদ সম্মেলন করবে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে। এ ছাড়া জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট রাজধানীর বিজয়নগর আল রাজি কমপ্লেক্সের সামনে এবং গণফোরাম (মন্টু) ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টি আরামবাগে সমাবেশ করে এক দফা ঘোষণা করবে। একই দিনে বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ ও এনডিপি এক দফা ঘোষণা দেবে। যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। আজ সোমবার বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবে সমমনা পেশাজীবী গণতান্ত্রিক জোট।

যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে এখন পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি বলে জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘এ নিয়ে আমাদের কার্যকর সিদ্ধান্ত নেই।’

গত ৩০ ডিসেম্বর ১০ দফা নিয়ে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি এবং সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া অনেকে নেতা মনে করেন, তাদের প্রথম দিকের কর্মসূচিগুলো পরিকল্পনামাফিক ছিল। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে বিচ্ছিন্নভাবে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। এবার পরিকল্পনা মাফিক আন্দোলনে ফেরার প্রস্তুতি চলছে।

আগামী ১৭ জুলাই খুলনায় এবং ২২ জুলাই ঢাকায় তারুণ্যের সমাবেশ করবে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। কৃষক-শ্রমিক-তাঁতী-মৎস্যজীবীদের সমন্বয়ে আগামী ১৪ জুলাই নোয়াখালীতে পদযাত্রা হবে। নোয়াখালীর পর ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম, ১৯ জুলাই দিনাজপুর, ২৮ জুলাই রাজশাহী, ৫ আগস্ট যশোর, ১২ আগস্ট হবিগঞ্জ ও ১৯ আগস্ট বরিশালে এ পদযাত্রা হবে। এসব কর্মসূচির সঙ্গে এক দফা আন্দোলনও চলবে।

এক দফার কর্মসূচির বিষয়ে মতামত নিতে গত এক সপ্তাহ ধরে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, গণফোরাম ও পিপলস পার্টির সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। এসব বৈঠকে ঢাকামুখী রোড মার্চ ও লং মার্চের মতো প্রস্তাবও আসে। হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের মতো কর্মসূচির পক্ষেও মত দেন অনেক নেতা। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, হরতাল-অবরোধের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এ ধরনের কর্মসূচির নেতিবাচক দিক বেশি। শুরুতে এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়া যাবে না।

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ। ধাপে ধাপে কর্মসূচি চূড়ান্ত অবস্থায় নেওয়া হবে। সভা-সমাবেশ, ঢাকা ঘেরাও, চল চল ঢাকা চলসহ ধারাবাহিকভাবে নানা কর্মসূচি আসবে। অহিংস পথেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে।’

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, মূলত দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে তারা গতানুগতিক সহিংসতার কর্মসূচি এড়িয়ে চলছে।

বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, ‘হরতাল-অবরোধে না গিয়ে এমন কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে, যেখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে।’

যুগপৎ আন্দোলনে থাকা একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথমে সাংগঠনিক বিভাগ কিংবা মহানগর পর্যায়ে কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। কর্মসূচি শুরু হতে পারে বিক্ষোভ সমাবেশ কিংবা মিছিল দিয়ে। তারপর পর্যায়ক্রমে সচিবালয়মুখী পদযাত্রা, ঢাকামুখী লং মার্চ, রোড মার্চ, ঢাকামুখী পদযাত্রা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়মুখী পদযাত্রা, ঢাকা ঘেরাও কিংবা ঢাকায় অবস্থান নেওয়ার মতো কর্মসূচির পক্ষে মতামত আসছে।

বিএনপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, গত বছর বিভাগীয় পর্যায়ের সমাবেশে বিএনপি প্রমাণ করেছে যে, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও সরকার পতন হতে পারে। ঢাকায় কয়েক লাখ নেতাকর্মীর উপস্থিতিতেও বিএনপি তখন কঠোর কর্মসূচিতে যায়নি। কারণ হলো, বিএনপি তখন চূড়ান্ত আন্দোলনে যেতে চায়নি।

এক দফার ‘মঞ্চ’ নিয়ে ভিন্ন মত

গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো পৃথক মঞ্চ থেকে এক দফার ঘোষণা দেবে। কিন্তু স্থায়ী কমিটির অন্তত তিনজন নেতা একমঞ্চ থেকে এক দফা ঘোষণার প্রস্তাব দেন। তাদের যুক্তি- মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরের সময় সরকারবিরোধী সব দল একমঞ্চ উঠলে সেটার চিত্রটাই ভিন্ন রকম হতো। বিদেশিরা দেখত, সরকারের বিরুদ্ধে সব দল এক হয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আজ গণতন্ত্র মঞ্চ ও এলডিপির সঙ্গে বিএনপির বৈঠক আছে। এ দুই দলের মতামত নেওয়ার পর কর্মসূচি চূড়ান্ত করবে বিএনপি।

প্রস্তুতি সভা

আগামী ১২ জুলাই নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠেয় সমাবেশকে সফল করতে ঢাকা বিভাগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ^রচন্দ্র রায়, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী উপস্থিত ছিলেন। এদিকে সভা করেছে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি। সমাবেশ সফল করতে আজ ঢাকা জেলা বিএনপি, কেন্দ্রীয় ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল পৃথক সভা করবে। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসব সভা হবে।

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব আমিনুল হক বলেন, সমাবেশ সফল করতে আমরা যৌথসভা করেছি। সভা থেকে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ সফল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ১২ জুলাই সমাবেশ থেকে এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা এবং নতুন কর্মসূচি আসবে।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিন বলেন, সমাবেশ সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আশা করি, এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশ হবে। সমাবেশের অনুমতির জন্য শনিবার ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এসএইচ-০১/১০/২৩ (অনলাইন ডেস্ক)