বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে চলছে বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপ। ইতিমধ্যে রোববার বাংলাদেশ সফরে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচনী দল। মঙ্গলবার ঢাকা আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জিয়া। মাসের শেষভাগে আসছেন ইইউর মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি। চলতি মাসে আসার সম্ভাবনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি জোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজের।
এ সফরগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্ব পাবে আগামী জাতীয় নির্বাচন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং শ্রম অধিকারের মতো বিষয়গুলো। বাংলাদেশের নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয় তার জন্য ভিসা নীতি গ্রহণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ইস্যুতে সম্প্রতি সরব হন যুক্তরাষ্ট্রের ১২ কংগ্রেসম্যান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৬ সংসদ সদস্য।
এর আগে গত ১২ জুন বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইউরোপী ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা দপ্তরের হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ও ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ বরেলকে চিঠি দিয়েছেন সংস্থাটির ছয় সংসদ সদস্য।
একই বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনকে গত ৮ জুন চিঠি লেখেন ছয় কংগ্রেসম্যান। এ ছাড়া গত ২৫ মে আরও ছয় কংগ্রেসম্যান এ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে চিঠি দিয়েছেন।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলে পশ্চিমা তৎপরতার বিপরীতে বাংলাদেশের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে চীন ও রাশিয়া। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের তৎপরতাকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং নব্য উপনিবেশবাদ বলে দাবি করছে পশ্চিমা বিরোধীরা।
নির্বাচনের আগে বিদেশিদের এ দৌড়ঝাঁপকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে সরকারি দল। অন্যদিকে দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে একে বন্ধু দেশগুলোর ভূমিকা হিসেবে দেখছে বিরোধী দলগুলো। তবে নিজ স্বার্থ সুরক্ষায় বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদারদের এমন ভূমিকা বলে মনে করেন অনেক কূটনীতিক।
বাংলাদেশে পশ্চিমা দেশগুলের যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্বার্থ রয়েছে, তা বিঘ্নিত হলে সে দায় কে নেবে?
এ বিষয়ে পশ্চিমা দূতাবাসের এক কূটনীতিক বলেন, আমাদের কাজের প্রতিনিয়ত জবাবদিহি করতে হয়। ফলে কোনো কাজ আমরা নিজ থেকে করি বিষয়টি এমন নয়। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা ও বাণিজ্য সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের। সেই সঙ্গে ভূরাজনৈতিক একটি বিষয়ও রয়েছে। কোনো দেশে যদি গণতন্ত্র ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে, তাহলে বিভিন্ন বাহ্যিক অপশক্তি নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করে। যা আন্তর্জাতিক রুল বেইজড অর্ডার বা আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর। ফলে উন্নত মানবাধিকার ও গণতন্ত্র জরুরি।
পশ্চিমা অনেক মিত্র দেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ এমন স্থানে অবস্থিত এবং অর্থনীতি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। অনেক সামাজিক সূচক ও উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে পরিচিত। এতে উন্নয়ন অংশীদারদের অবদান রয়েছে। ফলে এখানে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি বৈশ্বিক শান্তি ও শৃঙ্খলাকে ব্যাহত করতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বলেন, বাংলাদেশের অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য থাকলেও গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের অংশীদারদের এ ক্ষেত্রে উদ্বেগ দেখা যায়। যখন অংশীদাররা দেখেন একটি বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে, তখনই তাঁরা এতে ভূমিকা রাখেন।
তিনি বলেন, সমস্যাটি আমাদের অভ্যন্তরীণ। তবে এবার এর মাত্রা একটু বেশি। সংকট একটু বেশি গভীর হওয়ার করাণে নেতিবাচকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
বাংলাদেশে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা না গেলে তার প্রভাব বহির্বিশ্বেও পড়বে জানিয়ে সাবেক এ কূটনীতিক বলেন, বৈশ্বিকভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত না থাকলেও সেখানকার যুদ্ধে ক্ষতির শিকার আমরাও হচ্ছি। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অভিঘাত অন্য দেশের ওপর পড়তে পারে। সেই আশঙ্কা থেকেই বিদেশিরা ভূমিকা রাখেন।
গত শনিবার ঢাকা এসেছে ইইউর প্রাক-নির্বাচনী পর্যেবক্ষক দল। নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে ইইউর ৬ সদস্যের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ২৩ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করবে। প্রতিনিধি দলটির মূল কাজ হবে ইইউর সম্ভাব্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের কর্মপরিধি, পরিকল্পনা, বাজেট, লজিস্টিকস ও নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা। প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দ, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিবৃন্দ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবে। এ প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইইউ সিদ্ধান্ত নেবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এ জোট পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে কিনা। রোববার থেকে কাজ শুরু করেছেন ইইউ প্রতিনিধি দল। পুরো দিনটি সমমনা দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে কাটিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকা আসছেন। বুধবার প্রতিনিধি দলটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিদর্শন করবে। বৃহস্পতিবার প্রতিনিধি দলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করবে।
উজরা জিয়ার সফরে শ্রমিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠকের কথা রয়েছে। আগামী শুক্রবার মার্কিন প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ ছাড়বে।
এসএইচ-০৩/১০/২৩ (অনলাইন ডেস্ক)