ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য খুব বেশি নয়। তবে একেবারে কমও নয়। টেস্ট এবং সীমিত ওভারের ক্রিকেট মিলিয়ে মিলেছে অনেক ‘প্রথম’-এর তৃপ্তি। প্রথম ওয়ানডে জয়, প্রথম বারের মতো বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়া, বিশ্বকাপে প্রথম জয়, প্রথম টেস্ট জয়, প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয়, প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়, প্রতিপক্ষকে প্রথম হোয়াইটওয়াশ করা, বিশ্বকাপে প্রথম দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠা, প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রথম সেমিফাইনালে উঠা-এই প্রতিটা ‘প্রথম’ই বিশেষভাবে উদ্বেলিত করেছে দেশবাসীকে। এতো এতো ‘প্রথম’-এর হাত ধরে এবার মিলল আরও একটি ‘প্রথম’এর স্বাদ। টেস্টে প্রথম বারের মতো ইনিংস ব্যবধানে জিতল বাংলাদেশ।
মর্যাদার মাপকাঠিতে আগের সব ‘প্রথম’কে ছাপিয়ে নিশ্চিতভাবেই এই ‘প্রথম’কে সবার উপরে রাখবেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। দীর্ঘ ১৮ বছরের চেষ্টা, সংগ্রাম, লড়াই, সাধনার পর অর্জন যে ‘প্রথম’ তাকে তো উপরে রাখতেই হয়। তাছাড়া টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে জয় মানেই মাঠে প্রতিপক্ষকে নাস্তানুবাদ করার ছাড়পত্র। কোমর সোজা করে দাঁড়াতে না দেওয়া, চোখ রাঙিয়ে কথা বলতে না দেওয়ার প্রমাণ। সর্বোপুরি মাঠে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো!
ঢাকা টেস্টে এর সবকিছুই প্রমাণ করেছে সাকিব আল হাসানের দল। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং-তিন বিভাগেই সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নাস্তানুবাদ করেছে। তিন দিনেরও কম সময়ে টেস্টের যবনিকা টেনে দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে সাকিবের বাংলাদেশ। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ-একবারের জন্যও ক্যারিবীয়ানরা চোখ রাঙাতে পারেননি। উল্টো বাংলাদেশি বাঘদের সামনে পুরো ম্যাচেই ভয়ে কেঁপেছে এক সময়ের বিশ্বের পরাশক্তি ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
বাংলাদেশিরা একবার ব্যাটিং করে যে রান করেছে, ক্যারিবীয়রা দুদফা ব্যাটিং করেও তার ধারের কাছে যেতে পারেনি। বাংলাদেশের স্পিনারদের স্পিন আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১১১ রানে অলআউট হওয়া ক্যারিবীয়রা দ্বিতীয় ইনিংসে করতে পেরেছে ২১৩ রান। একবার ব্যাটিং করা বাংলাদেশ তাই ম্যাচটা জিতেছে ইনিংস ও ১৮৪ রানের বিশাল ব্যবধানে।
বিশাল এই জয়ে মিলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আরও একবার হোয়াইটওয়াশ করার তৃপ্তিও। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজটা জিতে নিল ২-০ ববধানে। তাতে মুছে গেল ২০০৯ সালে জেতা সেই সিরিজ জয়ের সঙ্গে অদৃষ্টে মিশে থাকা অপবাদটুকুও। টেস্ট সিরিজে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই প্রথম বারের মতো হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ২০০৯ সালে জেতা সেই সিরিজ জয়ের সঙ্গে একটু অপবাদ মিশে ছিল।
আর্থিক কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সিনিয়র ক্রিকেটাররা বোর্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল। আন্দোলনের অংশ হিসেবেই বোংলাদেশের সিরিজটি বয়কট করেছির তারা। ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাধ্য হয়ে জুনিয়রদের নিয়ে দল গড়েছিল। ফলে বাংলাদেশের জয়টা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় সারির দলের বিরুদ্ধে=এই অপবাদটুকু সহ্য করতে হয়েছে।
ওই অপবাদটা মুছে ফেলতে তাই দরকার ছিল পূর্ণ শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করা। দেরিতে হলেও সেটা প্রমাণ করে ছাড়ল সাকিব আল হাসানের দল। ইনিংস ব্যবধানে জেতাটা বাংলাদেশের জন্য কত বড় প্রাপ্তি বা অর্জন-সেটা একটা তথ্যেই স্পষ্ট হবে।
২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া বাংলাদেশর একটা সময় পর্যন্ত যেন নিয়তিই ছিল টেস্টে ইনিংস ববধানে হারা। বড় দলগুলোর মুখোমুখি হলেই মাঠ ছাড়তে হতো ইনিংস হারের লজ্জা নিয়ে। এই ঢাকা টেস্টসহ এ পর্যন্ত ১১২টি টেস্ট খেলল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৮৩টি টেস্টেই মিলেছে হারের তেতো স্বাদ।
এই ৮৩ হারের মধ্যে ৩৮টিতেই আবার ইনিংস হার। বিপরীতে প্রতিপক্ষকে ইনিংস ব্যবধানে হারানোর স্বাদ পায়নি কখনোই। ইনিংসে জেতা দূরের কথা, একটা সময় প্রতিপক্ষকে ইনিংস ব্যবধানে হারানোর কল্পনা করাটাও বাংলাদেশের জন্য ছিল কঠিন। এমন উচ্চাবিলাসী কল্পনা করা এখনো কঠিন। তবে ঢাকা টেস্টের মাধ্যমে যাত্রাটা শুরু হলো। জন্ম নিল ‘আমরাও ইনিংস ব্যবধানে জিততে পারি’ বিশ্বাস।
এখন দরকার অনেক চেষ্টায় অর্জিত এই বিশ্বাসকে পাথেয় করে সামনের পথে এগিয়ে যাওয়া। বিশ্বাসটাকে দৃঢ় করে আরও আরও ইনিংস জয়ের উন্মুক্ত করা। অনেক মর্যাদার এই ‘প্রথম’ রোমাঞ্চিত হয়ে সাকিব আল হাসানের দলও নিশ্চয় এখন নিজেদের বিশ্বাসের দরজাটা বিশ্ববাসীর সামনে খুলে দিতে বদ্ধপরিকর।
এসএইচ-১০/০২/১২ (স্পোর্টস ডেস্ক)