যেমনভাবে কাটছে নারী ক্রিকেটার চামেলীর দিনকাল

স্টার স্পোর্টস চ্যানেলে পুরান খেলা দেখাচ্ছে। চেয়ারে বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেই দিকে। কখনও চোখে মুখে খুশির ঝলক থাকলেও আবার কখনও মলিন হয়ে যা্েচ্ছ। এর মাঝে কখন যে মনের অজান্তে চোখের কোন বেয়ে পানি চলে আসছে তা আড়াল করার চেষ্টা করলেও পারছেন না। বিভিন্ন কথার উত্তর দিলেও থেকে থেকে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছেন। আসলে চিরচেনা সবুজ কার্পেটে মোড়ানো মাঠটি যে ক্রমশই অপরিচিত হয়ে উঠছে এই আক্ষেপ মনকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সবকিছু ঠিক হবার পরেও ফিরতে পারবেনত চিরচেনা সেই পরিবেশে। যে পরিবেশটা ছেড়ে এসেছেন সেই আট বছর আগে। যদিও সেচ্ছায় ছেড়ে আসা না। বড় ধরনের ইনজুরি তাঁকে বাইরে আসতে বাধ্য করেছে।

তাইত চিকিৎসা শেষে জরাজির্ন বাড়িতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রহর গুনছেন সুস্থ হয়ে উঠার। আর দিনরাত কাটছে কখনও টিভি দেখে, কখনও ফেসবুকে গচ্ছিত রাখা পুরোন স্মৃতি হাতড়িয়ে বা বৃদ্ধ মায়ের সাথে কিছুটা গল্প করে। প্রিয় সঙ্গিকে হারিয়ে যেন একাকিত্ব হয়ে পড়া। এক সময় যার ছোটাছুটি মাঠের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। সেই কিনা আজ ঐ প্রিয়াঙ্গন হারিয়ে ব্যাট, প্যাড গুছিয়ে রাখা ব্যাগের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নীরবে ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছেন। এমনি ভাবে দিক কাটছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক খেলোয়াড় চামেলী খাতুনের।

বাড়িটি দেখলেই বোঝা যায় কতদিন যে সংস্কার হয়নি তা বলা কঠিন। চামেলী নিজেও জানেন না কতদিন আগে এই বাড়িতে সিমেন্ট বালির আঁচড় পড়েছে। যার কারনে এখন ইটের দেয়ালের প্লাষ্টারগুলো খসে খসে পড়ছে। মাথার উপরের টালির ছাদের অবস্থাও খারাপ। বর্ষাকালে পানি পড়ে চুঁয়ে চুঁয়ে। আর শীতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। প্রতিটি ঘর যেনো হিমাগারে পরিনত হয়েছে। সূর্যের আলো ছড়ানোর মত পরিস্থিতি নেই। সাথে স্যাত স্যাতে ভাব আর গুমোট গন্ধ জীবনকে করে তুলছে আরো দুর্বিসহ। এমন একটা পরিবেশে শারীরিক অসুস্থা নিয়ে থাকতে হচ্ছে এই নারী ক্রিকেটারকে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক সহযোগিতা ও তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসা শেষে এই বাড়িতেই রয়েছেন। এখন তাঁর মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এমন পরিবেশ বেষ্ঠিত বাড়িতে তিনি আসলে কতটুকু সুস্থ হতে পারবেন। যেখানে তিনি দ্রুত সুস্থ হবার জন্য সংগ্রাম করছেন, সেখানে আশাহত হচ্ছেন পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে। ভারত থেকে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে আসার পর মাঝে মধ্যেই অসুস্থ থাকছেন। তাই তাঁর দ্রুত সুস্থ হবার পাশাপাশি মাঠে নামার বিষয়টি কপালে ভাঁজ ফেলছে। আজ যখন গোটা দেশ ক্রিকেট খেরোয়াড়দের নিয়ে মাতোয়ারা সেখানে একজন সাবেক খেলোয়াড়ের বাড়ির পরিস্থিতি এমন। যা বলা যেতে পারে বসবাসের অনুপযোগি।

এমন সব পরিস্থিতির মধ্যেও মাঠে ফেরার স্বপ্ন দেখছেন ক্রিকেটার চামেলী খাতুন। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ফের দেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের এই সাবেক অলরাউন্ডার। তার আশা একদিন লাল-সবুজ জার্সি পরে মাঠ মাতানোর সুযোগ পাবেন তিনি। ভারত থেকে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে দ্রুত সুস্থ হবার চেষ্টা চলছে তাঁর। লিগামেন্টের ইনজুরি তাকে ক্রিকেট জগৎ থেকে ছিটকে দিতে চাইলেও চিকিৎসার পর মনে সাহস পাচ্ছেন।

ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর বেসরকারি স্পর্শ অর্থপেডিক হাসপাতালের ডা. প্রশান্ত তেজওয়ানির দেয়া চিকিৎসাপত্র অনুয়ায়ি চলছে চমেলীর সকল কার্যক্রম। তবে শরীরচর্চার বিষয়ে তাঁকে যে পরামর্শ দেয়া হয়েছে তার প্রয়োজনীয় উপকরণ রাজশাহীতে নেই। তা রয়েছে কেবল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের জিমে। ফলে শরীর চর্চা প্রয়োজনমত হচ্ছে না। এর পরেও থেমে নেই চামেলী।

চোখে মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে যা বললেন চমেলী। আসলে পারিপার্শিক নানা প্রতিবন্ধকতা তাঁর দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে। তারপরেও তিনি থেমে নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ি যতটুকু সম্ভব নিজেকে সারিয়ে তোলার জন্য চেষ্টা করছেন। ভারত থেকে দেয়া চিকিৎসাপত্র আর স্থানীয় ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ রেখে নিজেকে দ্রুত সুস্থ করে তোলার জন্য সার্বিকভাবে চেষ্টা করছেন।

তিনি আপেক্ষের সুরে বলেন, যে প্রিয়াঙ্গনে যাদের সাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন তাদের সাথে খুব একটা তেমন যোগাযোগ হয় না। কেউ সেইভাবে খোঁজ খবরও নেন না। যেটা তাকে খুব পিড়া দেয়। তাই মোবাইলে সংরক্ষিত ছবিগুলোর সাথেই মাঝে মধ্যে কথা বলে নিজেকে হালকা করেন।

স্বপ্নের বাড়ি নির্মানের ব্যাপারে তিনি বলেন, জাতীয় দলে খেলার সময় দেশের অন্যান্য খেলোয়াড়দের মতই বুকে লালন করছিলেন নিজের মাথা গোঁজার ঠাইটুকু করতে পারবেন। কিন্ত মাঝপথে লিগামেন্ট ছিড়ে যাবার কারনে চিকিৎসা খরচ আর পরিবার পরিজনদের ব্যয়ভার বহন করতেই হিমশিম খেতে হয়। আনসার ভিডিপির মাসিক বেতন দিয়ে চলছে তাঁর পরিবারের খরচ। বর্তমানে তাঁর চিকিৎসা ব্যয় চলছে প্রধানমন্ত্রীর অর্থায়নে। গত ১৯ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রাধনমন্ত্রীর দেয়া ৫লাখ টাকার চেক পেয়েছেন।

বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের হয়ে ১৯৯৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত মাঠ মাতিয়েছেন চামেলী খাতুন। ২০১০ সালের এশিয়া কাপের রানার আপ হওয়া দলের হয়ে মাঠ মাতান এই দাপুটে ক্রিকেটার। এর বাইরে ঢাকা বিভাগে খেলেছেন টানা চার বছর। দুই মৌসুম শেখ জামালের ক্যাপ্টেন হিসেবে সামনে থেকে টেনে নিয়ে গেছেন দলকে। সেই তিনিই পরাস্ত হন ইনজুরিতে। এখন তার চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হবার প্রহর গুনছেন চামেলী।

এসএইচ-০৩/১৮/১৯ (সুমন হাসান)