বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া চিরতরুণ

ব্যাটে-বলে ২২ গজে যেন চিরতরুণ। কী দুর্দান্ত, কী দুরন্ত! ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাদা কিংবা রঙিন, সব জার্সিতেই ক্রিস গেইল ছড়িয়েছেন দ্যুতি। আপনি এই ব্যাটিং দানবের ব্যাটিংয়ে মুগ্ধ হতে পারেন, মুগ্ধ হতে পারেন তার লড়াকু মানসিকতায়। গেইল এই বয়সে এসেও মাঠে নামেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তাড়নায়। আহ, কী অসাধারণ! চল্লিশ পেরিয়ে গেলেও ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল যেন বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া এক চিরতরুণ।

বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানদের একজন ক্যারিবিয়ান কিং ক্রিস্টোফার হেনরি ক্রিস গেইল, আজ নিজের জীবনের ৪২ বছর পূর্ণ করে ফেলেছেন। সেই সঙ্গে সবথেকে বেশি বয়সী ক্রিকেটার হিসেবে আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে উইন্ডিজ দলের হয়ে মাঠ মাতাবেন বিধ্বংসী এ ব্যাটার। বয়স যে শুধুই সংখ্যা, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি।

২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ সালে গেইলের জন্ম ক্যারিবিয়ান দেশের জ্যামাইকার কিংস্টনে। এক অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মানো গেইলের জন্য ক্রিকেটকে নিজের ক্যারিয়ার করা এত সহজ হয়নি। কিন্তু তিনি নিজের এক অদ্ভূত ব্যাটিং শৈলীতে আজ ক্রিকেট জগতের সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিত হয়েছেন।

ক্রিকেট জগতে উইন্ডিজের গেইলের নামের পাশে এমন কিছু কৃতিত্ব রয়েছে যা অন্য ব্যাটসম্যানদের জন্য ভাবাও বড় ব্যাপার বলে ধরা যেতে পারে।

ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলায় সারা বিশ্ব তাকে টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালা বলে সম্বোধন করে থাকে। তিনি বিশ্বের প্রায় সব ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগই মাতিয়ে থাকেন। এমনকি আমাদের দেশের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বিপিএলেও খেলেছেন।

তার সর্বোচ্চ ছক্কা ও সেঞ্চুরি করার রেকর্ড রয়েছে। ভারতের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ আইপিএলে সর্বোচ্চ ১৭৫ রান করার রেকর্ডটিও যে তার। তাছাড়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ছক্কা হাঁকানোর নজিরও গড়েছেন তিনি। এই ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি ১৩টি হাফসেঞ্চুরি তার। ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগের উদ্বোধনী আসরে প্রথম ফ্রাঞ্চাইজি খেলোয়াড় হিসেবে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তিনি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুইবার সেঞ্চুরি করেন৷ ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে পুনে ওয়ারিয়র্সের বিপক্ষে ৩০ বলে সেঞ্চুরি করেন। যেটি বর্তমানে টি-টোয়েন্টি এবং ক্রিকেটের যে কোনো ফরম্যাটের ইতিহাসে দ্রুততম সেঞ্চুরি। আগের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের ৩৪ বলে। ম্যাচে তিনি অপরাজিত ১৭৫ (৬৬ বলে) রান করেন। এ ইনিংসে তিনি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ১৭টি ছক্কা হাঁকান। এর ফলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের খেলোয়াড় ব্রেন্ডন ম্যাককালামের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি ম্লান হয়ে যায়।

২০০৭ সালের টি-টেয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরের প্রথম ম্যাচেই স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫৭ বলে ১১৭ রান করেন গেইল, যা একসময় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয়েছিল। এছাড়াও সেঞ্চুরিটি ছিল টি-টোয়েন্টিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম শতক। এর ফলে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ৩টি সংস্করণ তথা টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির প্রত্যেকটিতেই সেঞ্চুরি করে বিরল রেকর্ড গড়েন।

১৯ বছর বয়সে জ্যামাইকার পক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে গেইলের। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষ হয়ে যুবদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলেন। এগারো মাস পর খেলেন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। এর ছয় মাস পর টেস্ট ম্যাচে অভিষেক হয় তার। ১৯৯৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ক্রিকেট বিশ্বে আবির্ভাব হয় গেইলের। ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়েই শুরু হয় তার ক্রিকেটযাত্রা। উইন্ডিজের টেস্ট দলে সুযোগ পান ২০০০ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ছোট ফরম্যাটে অভিষেক হয় ২০০৬ সালে।

অভিষেকের পর থেকে টেস্ট ক্রিকেটে ১০৩ ম্যাচে ৭ হাজার ২১৪ রান করেছেন গেইল। যার মধ্যে ১৫টি শতক ও ৩৭টি অর্ধশতক রয়েছে। টেস্টে তার সর্বোচ্চ সংগ্রহ ৩৩৩ রান (শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে; ২০১০ সালে)। পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন ৭৩টি উইকেট।

উইন্ডিজের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ৩০০টি ওয়ানডে খেলে সর্বোচ্চ ১০৪৮০ রান করেছেন গেইল। রয়েছে ১৫টি সেঞ্চুরি ও ৫৪টি হাফসেঞ্চুরি। রয়েছে একটি ডাবল সেঞ্চুরি। এই ফরম্যাটে তার সর্বোচ্চ সংগ্রহ ২১৫ রান (২০১৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে)। পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন ১৬৭টি উইকেট।

এখন পর্যন্ত ৭৪টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলে তার সংগ্রহ ১৮৫৪ রান। যার মধ্যে রয়েছে ২টি শতক ও ১৪টি অর্ধশতক। ১১৭ রান হচ্ছে তার এই ফরম্যাটের সর্বোচ্চ সংগ্রহ। পাশাপাশি বল হাতে শিকার করেছেন ১৯টি উইকেট।

টি-টোয়েন্টি ফেরিওয়ালাখ্যাত এ ব্যাটিং দানব সবধরনের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এই পর্যন্ত খেলেছেন ৪৪৬টি ম্যাচ। প্রায় ৩৭ গড়ে রান করেছেন ১৪২৬১। শতক করেছেন ২২টি আর অর্ধশতক ৮৭টি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এ ব্যাটিং দানবের ছক্কা হাঁকানোর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। টি-টোয়েন্টিতে এ পর্যন্ত ছক্কা হাঁকিয়েছেন ১০৪২টি। চার মেরেছেন ১১০৪টি। পাশাপাশি বল হাতে শিকার করেছেন ৮২টি উইকেট। ২২ রান খরচায় ৪ উইকেট তাঁ ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ফিগার।

শুধু রান দিয়ে আপনি কখনোই গেইলকে বিবেচনা করতে পারবেন না। ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে গেইল যেন এক রহস্য। গেইল এক আশ্চর্য প্রদীপ, গেইল এক ঝড় যিনি একাই লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারেন প্রতিপক্ষ শিবির। ছক্কা মাস্টার গেইল সম্পর্কে স্বদেশী কিংবদন্তি ব্রায়ান লারা বলেছিলেন, ‘যখন গেইল ব্যাট করে তখন ফিল্ডাররা দর্শক হয়ে যায় আর দর্শকরা ফিল্ডার।’

বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আজও খেলে যাচ্ছেন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েননি এখনো। আসলে গেইলরা কখনোই বয়সের ভারে নুয়ে যান না, পরিশ্রম আর দৃঢ় মনোবলে এগিয়ে যান সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে অনন্য উচ্চতায়। বয়স শুধুই যে একটি সংখ্যা মাত্র, ক্রিকেট বিশ্বে তার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবেন তিনি।

এসএইচ-২৫/২১/২১ (স্পোর্টস ডেস্ক)