বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনে শ্রমিকদের মৃতের সংখ্যায় গড়মিল

কাতারে বিশ্বকাপ ২০২২ শুরু হচ্ছে ২০শে নভেম্বর, রবিবার। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফুটবল ভক্তরা তাদের প্রিয় দলের খেলা দেখার জন্য ইতোমধ্যে কাতারে গিয়ে পৌঁছাতে শুরু করেছেন।

এই সমর্থকরা কাতারে যেসব হোটেলে অবস্থান করবেন এবং যেসব স্টেডিয়ামে খেলা দেখবেন, হাজার হাজার বিদেশি শ্রমিক কয়েক বছর ধরে সেগুলো নির্মাণ করেছেন।

এসব বিদেশি শ্রমিকের সাথে কাতার যে ধরনের আচরণ করেছে তাতে উপসাগরীয় এই দেশটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

বিশ্বকাপকে সামনে রেখে কাতার সাতটি স্টেডিয়াম নির্মাণ করেছে। একই সাথে একটি নতুন বিমানবন্দর, পাতাল রেল অবকাঠামো, বেশ কয়েকটি সড়ক এবং ১০০টির মতো নতুন হোটেলও নির্মাণ করা হয়েছে।

যে স্টেডিয়ামে ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে তাকে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন একটি শহর।

কাতার সরকার বলছে শুধুমাত্র স্টেডিয়াম নির্মাণ করতেই ৩০ হাজারের বেশি বিদেশি শ্রমিক কাজ করেছে।

এসব শ্রমিকের বেশিরভাগই নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং ফিলিপিন্স থেকে।

ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বলেছে বিশ্বকাপ আয়োজনের বিডে জয়ী হওয়ার পর থেকে ৬,৫০০ অভিবাসী শ্রমিক নিহত হয়েছে।

এসব শ্রমিক ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার নাগরিক।

মৃত্যুর এই সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে কাতারে এসব দেশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে।

তবে কাতার সরকার বলছে মৃত্যুর এই মোট হিসাব বিভ্রান্তিকর, কারণ এই হিসেবে যেসব শ্রমিক যোগ করা হয়েছে তাদের সবাই বিশ্বকাপের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রকল্পে কাজ করছিলেন না।

কাতার বলছে, যারা মারা গেছেন তাদের অনেকেই কাতারে কয়েক বছর ধরে কাজ করছিলেন। তাদের কেউ কেউ বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যেতে পারে কিম্বা কারো কারো স্বাভাবিক মৃত্যুও হয়ে থাকতে পারে।

কাতার সরকার বলছে তাদের কাছে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর যে রেকর্ড আছে তাতে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে যারা বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামের নির্মাণ এলাকায় মারা গেছেন। এবং এদের মধ্যে মাত্র তিনজন “কাজ করতে গিয়ে” মারা গেছেন।

তবে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এরকম একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন আইএলও বলছে, কাতার সরকার মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে বলছে।

সংস্থাটি বলছে কাতার সরকার এই হিসেবের মধ্যে যারা হার্ট অ্যাটাক এবং শ্বাসপ্রশ্বাস সংক্রান্ত সমস্যার কারণে মারা গেছে তাদেরকে “কাজ করতে গিয়ে” মৃত্যু হিসেবে ধরা হয়নি, যদিও প্রচণ্ড গরমে উচ্চ তাপমাত্রায় ভারী কাজ করার কারণে হিটস্ট্রোকে এসব মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।

আইএলও নিজেই বিশ্বকাপের সঙ্গে সম্পর্কিত এসব দুর্ঘটনার একটি হিসেব তৈরি করেছে। কাতারে সরকার-পরিচালিত হাসপাতাল এবং অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই হিসেবটি তৈরি করা হয়েছে।

সংস্থাটি বলছে শুধুমাত্র ২০২১ সালেই ৫০ জন বিদেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে এবং আরো ৫০০ জনের বেশি শ্রমিক গুরুতরভাবে আহত হয়েছে।

তারা বলছে যে এছাড়াও আরো ৩৭,৬০০ শ্রমিক আহত হয়েছে। অথচ কাতার সরকার বিদেশি শ্রমিকের মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে দেখাচ্ছে।

কাতারে ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয় ২০১০ সালে। এর পর থেকেই মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিদেশি শ্রমিকদের সাথে কাতার সরকারের আচরণের সমালোচনা করে আসছে।

লন্ডন-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৬ সালে অভিযোগ করে যে কাতারের কোম্পানিগুলো বিদেশি শ্রমিকদের দিয়ে জোরপূর্বক কাজ করাচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে বহু শ্রমিক নোংরা জায়গায় বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে, কাজ পাওয়ার জন্য তাদেরকে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়েছে, অনেকের মজুরি দেওয়া হয়নি, এবং তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে নিয়েছে।

বিদেশি শ্রমিকদের অত্যন্ত গরমের মধ্যে কাজ করার সময় তাদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে কাতার সরকার ২০১৭ সাল থেকে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে তাদের কাজের সময় সীমিত করে দেওয়া, এবং কাজের পরিবেশের মান উন্নত করা।

তবে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২১ সালে তাদের প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলেছে যে বিদেশি শ্রমিকদের “মজুরি কেটে নেওয়া হচ্ছে অবৈধভাবে এবং শাস্তি হিসেবে,” এবং “কঠিন এই কাজের জন্য অনেকে মাসের পর মাস তাদের মজুরিও পাচ্ছে না।”

কাতারের কোম্পানিগুলো “কাফালা” নামের একটি ব্যবস্থার অধীনে কাজ করে। এই ব্যবস্থায় কোম্পানিগুলো বিদেশি শ্রমিকদের কাতারে নিয়ে আসে, কিন্তু তাদেরকে কাজ ছেড়ে চলে যেতে দেয় না।

আইএলওসহ বিভিন্ন গ্রুপের চাপের কারণে কাতার সরকার এই কাফালা পদ্ধতি বাতিল করে।

তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, তার পরেও শ্রমিকরা যাতে এক কাজ ছেড়ে আরেক কাজে চলে না যায় – সেজন্য কোম্পানিগুলো শ্রমিকদের ওপর চাপ দেওয়া অব্যাহত রেখেছে।

সংস্থাটি সতর্ক করে দিয়ে বলেছে কাতারে শ্রম-অধিকার সংস্কারে যে অগ্রগতি হয়েছে তা যেন বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই থেমে না যায়।

শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কাতার সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর সঙ্গে কাজ করছে।

এবিষয়ে সরকার বেশ কিছু সংস্কার কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে।

এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মজুরি রক্ষা স্কিম যাতে নিয়োগ-দাতারা শ্রমিকদের মজুরি যথা সময়ে পরিশোধ করেন।

কাতার সরকারের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন সংস্কারের কাজ এগিয়ে চলেছে এবং তার ফলে কাতারে বেশিরভাগ বিদেশি শ্রমিকের কর্ম-পরিবেশের উন্নতি হচ্ছে।

“এসব সংস্কার কর্মসূচি যাতে কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করা হয় সেটা নিশ্চিত করার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য রকমের অগ্রগতি হয়েছে,” বলেছেন কাতার সরকারের একজন মুখপাত্র।

“এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে যেসব কোম্পানি নিয়মনীতি ভঙ্গ করছে তাদের সংখ্যাও কমে আসবে,” বলেন তিনি।

ধারণা করা হচ্ছে বিশ্বকাপ চলাকালেও এবিষয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।

আন্তর্জাতিক ফুটবল পরিচালনাকারী সংস্থা এবং বিশ্বকাপের আয়োজক ফিফা অংশগ্রহণকারী ৩২টি দলকে চিঠি দিয়ে বলেছে, “এখন যেন তারা ফুটবল খেলার দিকে মনোযোগ দেয়।”

ফিফা বলছে, খেলার বিষয়টিকে যেন আদর্শগত অথবা রাজনৈতিক “যুদ্ধে” টেনে না নেওয়া হয়।

এর জবাবে ইউরোপীয় ফুটবলের দশটি সমিতি বলেছে, “মানবাধিকার একটি সার্বজনীন বিষয় এবং এটি সবখানেই প্রযোজ্য।”

অস্ট্রেলিয়ার ফুটবল দল একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যাতে বিদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে খারাপ আচরণের জন্য কাতারের সমালোচনা করা হয়েছে।

কাতারের খারাপ মানবাধিকার রেকর্ডের প্রতিবাদ জানাতে ডেনিশ ফুটবলাররা কালো জার্সি পরে মাঠে নামবেন বলেও জানা গেছে।

এসএইচ-০১/১৯/২২ (স্পোর্টস ডেস্ক)