বিশ্বকাপ ফুটবলে যতোগুলো বড় ধরনের অঘটন ঘটেছে তার একটি ঘটিয়েছে সৌদি আরব। এবারের বিশ্বকাপে সি গ্রুপের উদ্বোধনী ম্যাচে তারা দু’বারের শিরোপা জয়ী আর্জেন্টিনাকে পরাজিত করে সবাইকে চমকে দিয়েছে।
বিশ্ব ফুটবল র্যাংকিং-এ সৌদি আরবের অবস্থান ৫১তম। আর আর্জেন্টিনা এবারের বিশ্বকাপে অন্যতম ফেভারিট।
পেনাল্টি থেকে লিওনেল মেসির করা গোলে আর্জেন্টিনা এগিয়ে গেলেও দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম ১০ মিনিটের মধ্যে দুটো গোল করে এগিয়ে যায় সৌদি আরব।
আর্জেন্টিনা আর খেলায় ফিরতে পারেনি।
এই ম্যাচটিকে দেখা হচ্ছে এবারের বিশ্বকাপের প্রথম অঘটন হিসেবে।
এধরনের অঘটনের কারণেই বিশ্বকাপ বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
কিন্তু এই টুর্নামেন্টের ইতিহাসে এরকম বড় ধরনের অঘটন আরো কী কী ঘটেছে?
গ্যারি লিনেকার বলেন, অ্যালান শিয়েরার এবং মিকা রিচার্ডস ম্যাচ অফ দ্যা অনুষ্ঠানে এরকম কিছু অঘটন নিয়ে আলোচনা করেছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার স্বপ্ন ২০০২ সালের বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল।
বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্ব যা শেষ ১৬ নামেও পরিচিত, সেখানে তারা ইতালিকে ২-১ গোলে নাটকীয়ভাবে পরাজিত করে।
দক্ষিণ কোরিয়ার খেলোয়াড় আন জুং-হয়ান, যিনি আগের দুটো মওসুমে ইতালির ক্লাব পেরুইয়ার হয়ে খেলেছেন, ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে গোল্ডেন গোলের মাধ্যমে তিনি ইতালির বিরুদ্ধে তার দলকে জিতিয়ে দেন।
ইতালি ছিল তারকাসমৃদ্ধ একটি দল। বুফো, মালদিনি এবং দেল পিয়েরোর মতো খেলোয়াড়েরা তখন ইতালিতে খেলেছেন।
গ্যারি লিনেকার বলেন, ওটা ছিল অনেক বড় অঘটন এবং ওটা দারুণ ম্যাচ ছিল।
“দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবলের উন্নতি হয়েছে এবং এটা ছিল তার শুরু। কোনো একটি দল শক্তিশালী হলে তাতে সবসময়ই কিছু অজানা বিষয় থাকে। গোলের মূল্য অনেক বেশি যা একটি দলকে অনেক কিছু দিতে পারে,” বলেন তিনি।
ফুটবল বিশ্লেষক মিকা রিচার্ডস বলেছেন, “ওই ম্যাচটা অনেক বড় অঘটন ছিল। একই সাথে দক্ষিণ কোরিয়াও ছিল বেশ ভাল একটি দল।”
ব্রাজিলে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে স্পেন তাদের গ্রুপের উদ্বোধনী ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের কাছে ৫-১ গোলের বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়।
এর মধ্য দিয়ে ডাচরা ২০১০ সালের ফাইনালে স্পেনের কাছে পরাজিত হওয়ার প্রতিশোধ নেয়। সেবার স্পেন ১-০ গোলে নেদারল্যান্ডসে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
বর্তমান চ্যাম্পিয়ন কোনো দলের জন্য ৫-১ গোলে হেরে যাওয়াও ছিল সবচেয়ে বড় ব্যবধানে পরাজয়।
ফুটবল বিশ্লেষক অ্যালান শিয়েরার বলেন, স্পেন তাদের পরের খেলাতেও হেরেছে এবং শিরোপাধারী দল হয়েও টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছে।
গ্যারি লিনেকার বলেন, “নেদারল্যান্ডস সেদিন স্পেনকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল এবং আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না তাদের কী হয়েছিল।”
পশ্চিম জার্মানি দলের অধিনায়ক ছিলেন ফ্রানৎস বেকেনবাওয়ার এবং এই দলে ছিল গের্ড ম্যুলারের মতো দারুণ স্ট্রাইকার। পূর্ব জার্মানির বিরুদ্ধে তারাই ছিল ফেভারিট।
কারণ পশ্চিম জার্মানিই ছিল আয়োজক দেশ। তারা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নও ছিল।
তবে শেষ মুহূর্তে ইয়ুর্গেন স্পারভাসার গোল করে পূর্ব জার্মানিকে ১-০ গোলে জিতিয়ে দেন।
এই জয়ের ফলে তারা তাদের গ্রুপের শীর্ষে চলে যায়।
গ্যারি লিনেকার বলেন, “সেসময় পশ্চিম জার্মানির অনেক শক্তি ছিল। এই পরাজয় ছিল বিস্ময়কর কারণ সেবছর তারাই বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল।”
নেদারল্যান্ডসকে ২-১ গোলে পরাজিত করে সেবার চ্যাম্পিয়ন হয় পশ্চিম জার্মানি।
সেনেগাল ১-০ ফ্রান্সকে হারানোর ঘটনাটি ছিল বিশ্বকাপের আরো একটি অঘটন।
এর আগের বিশ্বকাপে শিরোপাজয়ী ফ্রান্স ১-০ গোলে হেরে যায় সেনেগালের কাছে। পাপা বুবা ডিওপ জয়সূচক গোলটি করেন।
কোরিয়া ও জাপানে ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে এই অঘটন ঘটে।
সেনেগাল সেবারই প্রথম বিশ্বকাপে খেলতে আসে। এবং তারা কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
আর্জেন্টিনায় ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসকে ৩-২ গোলে পরাজিত করে সবাইকে চমকে দেয় স্কটল্যান্ড।
ওই ম্যাচে স্কটল্যান্ডের আর্চি গেমিল যে অসাধারণ গোলটি করেছিলেন সেটি বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা গোল হিসেবে বিবেচিত।
স্কটল্যান্ড তখনও ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল এবং খেলার বাকি ছিল ২০ মিনিট। তিনজন ডাচ ডিফেন্ডারকে আঁকাবাঁকা পথে কাটিয়ে গেমিল শান্তভাবে বলটি সামনের দিকে এগিয়ে আসা গোলকিপারের উপর দিয়ে জালে পাঠিয়ে দেন।
ফুটবল বিশ্লেষক অ্যাল্যান শিয়েরার বলেন, “আমি এখনও ওই গোলটির কথা মনে করতে পারি। ডান দিক দিয়ে ভেতরে ঢুকে কীভাবে তিনি গোলটি করেছিলেন। স্কটল্যান্ডের সেসময় ভালো কিছু খেলোয়াড় ছিল। নেদারল্যান্ডস সেবার ফাইনালে পৌঁছে ছিল।”
২০১০ সালে স্পেন ছিল ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন। একই সাথে তারা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ওই বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট দল।
কিন্তু ওই টুর্নামেন্টে স্পেন ভালো খেলতে পারেনি।
প্রথম ম্যাচেই তারা সুইজারল্যান্ডের কাছে ১-০ গোলে হেরে হোচট খায়।
ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটির সাবেক মিডফিল্ডার গেলসন ফার্নান্দেস জয়সূচক ওই গোলটি করেছিলেন।
ব্রাজিলে ১৯৫০ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ছিল অন্যতম ফেভারিট।
আশা করা হয়েছিল যে তারা খুব সহজেই যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করবে।
কারণ তখন যুক্তরাষ্ট্র দলে ছিল আধা-পেশাদার ও আনাড়ি সব খেলোয়াড়।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের টিমে হাইতি-বংশোদ্ভূত একজন ফুটবলার জো গেজেন্স, যিনি ছিলেন হিসাব বিজ্ঞানের ছাত্র এবং একসময় ব্রুকলিন রেস্তোরায় হাড়ি পাতিল ধোয়ার কাজ করেছেন, তিনি একমাত্র গোলটি করে সবাইকে চমকে দেন।
গ্যারি লিনেকার বলেন, “এটা অনেক বড় অঘটন ছিল। ইংল্যান্ডের বিলি রাইট, স্ট্যান মর্টেনসেনের ও টম ফিনির মতো ফুটবলার ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ড সেবার বেশ বিব্রত হয়েই দেশে ফিরেছে।”
মেক্সিকোতে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্ট জিতে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন দিয়েগো ম্যারাডোনা।
কিন্তু মাত্র চার বছর পরে ১৯৯০ সালে ইতালিতে আয়োজিত বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে হেরে যায় ক্যামেরুনের কাছে।
মিলানে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে গোলটি করেন ফ্রাঁসোয়া ওমাম-বিয়িক।
ওই ম্যাচে ক্যামেরুনের দুজন খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত মাত্র ন’জন ফুটবলারকে নিয়ে তারাই আর্জেন্টিনাকে পরাজিত করে।
অ্যালান শিয়েরার বলেন, “সেটা ছিল মিলানের এক বিস্ময়কর ঘটনা।”
গ্যারি লিনেকার বলেন, “ক্যামেরুন ছিল জমকালো এক দল। তারা খুব সুন্দর ফুটবল খেলেছে। তাদের খেলায় বুদ্ধিমত্তার ছাপ ছিল।”
১৯৮২ সালে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় স্পেনে।
টুর্নামেন্টের পরের পর্বে যাওয়ার জন্য স্পেনের বিরুদ্ধে উত্তর আয়ারল্যান্ডের জয়ের দরকার ছিল।
নিজেদের মাঠে ১-০ গোলে হেরে যায় স্পেন।
জেরি আর্মস্ট্রং দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই জয়সূচক গোলটি করেন।
তবে এই ম্যাচটি আরো স্মরণীয় হয়ে আছে একারণে যে তাদের একজন খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখিয়ে বের করে দেওয়া হলে দ্বিতীয়ার্ধের বেশিরভাগ সময় তারা ১০ জন নিয়ে খেলে জয়লাভ করেন।
অ্যাল্যান শিয়েরার বলেন, “উত্তর আয়ারল্যান্ডের স্পেনকে হারিয়ে দেওয়া ছিল একটি বিরাট ঘটনা। যদিও তারা ১০ জন নিয়ে খেলেছে।”
গ্যারি লিনেকার বলেন, “এই ম্যাচ জেরি আর্মস্ট্রং-এর জীবন বদলে দিয়েছে। পরে তিনি স্পেনে চলে যান এবং স্পেনে ফুটবল বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। মাত্র একটা গোলই তার জীবন বদলে দিয়েছে।”
১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট ছিল ইতালি।
কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার জন্য তাদের জন্য উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে শুধু ড্র করার প্রয়োজন ছিল।
সেবারই বিশ্বকাপে খেলা শুরু করে উত্তর কোরিয়া।
কিন্তু তারা শক্তিশালী ইতালিকে ১-০ গোলে পরাজিত করে সবাইকে চমকে দেয়।
পাক দু-ইক গোলটি করেন এবং তারা কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায়।
সেবার ইতালিকে অনেক আগেই লজ্জার সঙ্গে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
এসএইচ-০৯/২৩/২২ (স্পোর্টস ডেস্ক)