টানটান উত্তেজনায় মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারত

বিশ্বকাপ ক্রিকেটে – তা সে ওয়ানডে বা টিটোয়েন্টি যে ফর্ম্যাটেই হোক – বাংলাদেশ আর ভারত মুখোমুখি হলেই নাটকীয়তার ছড়াছড়ি থাকে সাধারণত। মাঠের বাইরে যেমন, মাঠের ভেতরেও – আর এই ট্র্যাডিশন সেই ২০০৭-এ ক্যারিবিয়ান থেকে চলছে।

সেই ষোলো বছর আগে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরেই কার্যত টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল ভারতকে। ঘটনাচক্রে বাংলাদেশ ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ তারকা সাকিব আল হাসানের সেটাই ছিল প্রথম বিশ্বকাপ, আর ভারতকে হারানোতে বড় ভূমিকা রেখেছিল তরুণ সাকিবের হাফ সেঞ্চুরি।

বৃহস্পতিবার তার এতকাল বাদে পুনে-তে মহারাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের মাঠে সেই বিশ্বকাপের আসরেই যখন দুই দল মুখোমুখি হচ্ছে, তখন কিন্তু ছবিটা সম্পূর্ণ উল্টো।

বাংলাদেশের হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও বুধবার সন্ধ্যায় স্বীকার করলেন, এই মুহুর্তে টুর্নামেন্টে ‘ইন ফর্ম’ টিম হল ভারতই – যারা দুর্ধর্ষ খেলছে।

অন্য দিকে বাংলাদেশের জন্য শেষ চারে যাওয়ার লড়াইয়ে টিঁকে থাকতে এই ম্যাচটা জেতা ভীষণ ভীষণ জরুরি – ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে পরপর দুটো ম্যাচে হেরে তাদের পিঠ একরকম দেওয়ালে ঠেকে গেছে বলা চলে।

বাংলাদেশের জন্য আরও দুশ্চিন্তার কথা, সাকিব আল হাসানকে এই ম্যাচে পাওয়া যাবেই – তা এখনও একশো ভাগ নিশ্চিত নয়।

ভারতও পাশাপাশি জানিয়ে রেখেছে, বিশ্বকাপে খেলা দল হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা সমীহ করছে ঠিকই – তবে তারা পর পর তিনটে ম্যাচে জেতার ‘মোমেন্টাম’টা এই ম্যাচেও ধরে রাখতে চায়।

দলের বোলিং কোচ পরশ মাম্বরে এটাও জানিয়ে দিলেন, ‘রোটেশন’ পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা ভারত এখন মোটেই ভাবছে না – যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে যশপ্রীত বুমরা বা কুলদীপ চাহাল, কিংবা শ্রেয়স আইয়ার-হার্দিক পান্ডিয়া – কাউকেই বিশ্রাম দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা টিম ম্যানেজমেন্টের নেই।

পুনের এই মাঠ খুব ভাল ব্যাটিং উইকেট হবে বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে – এবং বৃহস্পতিবার একটা হাই-স্কোরিং ম্যাচ দেখার প্রত্যাশাতেই রয়েছেন দর্শকরা।

পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে বলতে হবে, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে তাদের খেলা শেষ চারটে ওয়ান-ডের তিনটেতেই জিতেছে। যার মধ্যে শেষটা আবার গত মাসেই, এশিয়া কাপে।

বিশ্বকাপে আবার দু’দলের যে চারবার দেখা হয়েছে, তার মধ্যে তিনবারই জিতেছে ভারত। তবে এসব পুরনো পরিসংখ্যান হয়তো অনেকটাই অর্থহীন।

চলতি বিশ্বকাপে আইসিসি-র স্লোগান হল, ‘ইট টেকস ওয়ান ডে’!

এটার এমনও অর্থ করা যায়, ক্রিকেটে একটা দিনেই সব পুরনো হিসেব ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে! র‍্যাঙ্কিংকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আফগানিস্তান ইংল্যান্ডকে হারাতে পারে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হতবাক করে দিতে পারে ‘দুর্বল’ নেদারল্যান্ডস।

বাংলাদেশের হেড কোচ যেমন বলেই গেলেন, “আমাদেরও টুর্নামেন্টে ওরকম একটা দিন কিন্তু পাওনা!”

বিশ্বকাপে এ সপ্তাহে অনেক বড় বড় অঘটন ঘটছে – বৃহস্পতিবারও তেমনই একটা দিন হতে যাচ্ছে কি না সে উত্তর পেতে অপেক্ষা আর মাত্র কয়েক ঘন্টারই!

গত শুক্রবার চেন্নাইতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে খেলার সময় সাকিব আল হাসান উরুর পেশীতে যে চোট পেয়েছিলেন, সেটা পুরোপুরি সেরে গেছে তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না।

তবে বুধবার ও পরশু – দু’দিনই তিনি নেটে প্র্যাকটিস করেছেন। চুটিয়ে ব্যাটিং করলেও তাকে অবশ্য বল করতে দেখা যায়নি।

ম্যাচের আগের সন্ধ্যায় হাথুরুসিংহে জানালেন, সাকিব এখন ‘ওকে’! ভাল ব্যাটিং প্র্যাকটিস করেছে – রানিং বিটুইন দ্য উইকেটেও স্বচ্ছন্দ ছিল রীতিমতো।

এরপর বুধবার তাকে আবারও পাঠানো হয়েছে হাসপাতালে স্ক্যান করাতে। সেটার রিপোর্টের ভিত্তিতেই আজ সকালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সাকিব খেলবেন কি না।

কীভাবে সেই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হবে, সেটারও একটা আভাস দিয়েছেন হাথুরুসিংহে।

“প্রথম কলটা আমাদের মেডিক্যাল টিমের। তারা স্ক্যান রিপোর্ট ও আরও সব কিছু দেখে হয় গ্রিন সিগনাল বা রেড সিগনাল দেবেন। রেড সিগনাল দিলে তো আর খেলার প্রশ্নই নেই।“

“আর মেডিক্যাল টিমের সবুজ সংকেত পেলে কোচ ও ক্যাপ্টেন (মানে সাকিব নিজে) মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন খেলানোটা ঝুঁকি হয়ে যাবে – না কি খেলানোই উচিত হবে”, জানান তিনি।

তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট মহলে যারা সাকিবকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন – তারা একবাক্যে বলছেন খেলার সামান্যতম সুযোগ থাকলে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ ম্যাচটা যে কোনওভাবে হোক খেলবেন!

পুনে শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় সোয়া ঘন্টার দূরত্বে মুম্বাই-পুনে এক্সপ্রেসওয়ের ধারে মহারাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের স্টেডিয়ামে এই প্রথম বিশ্বকাপের কোনও ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

দীর্ঘ সাতাশ বছর আগে পুনেতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ম্যাচ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা শহরের অন্য মাঠে।

আজকের ম্যাচ যেখানে হচ্ছে, সেই মাঠটা মাত্রই দশ-বারো বছরের পুরনো। ঝকঝকে নতুন এবং আধুনিক স্টেডিয়াম।

ভারত ও বাংলাদেশ দুটো টিমই এক সুরে জানিয়ে গেল, এটা একটা দারুণ ব্যাটিং সারফেস এবং বোলারদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং!

ভারতের বোলিং কোচ পরশ মাম্বরের কথায়, “এই সারফেসে বল পড়ে খুব ভালভাবে ব্যাটে আসে। তার ওপর তুলনামূলকভাবে ছোট মাঠ, চার ছক্কাও বেশি হবে ধরে নেওয়া যায়।“

“মাঠটা একটু অল্টিচিউডেও (উচ্চতাতেও) আছে। সব মিরিয়ে পুনের মাঠ বোলারদের জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং হবে বলে ধরে নিচ্ছি ও সেভাবেই আমরা পরিকল্পনা সাজাচ্ছি”, জানালেন তিনি।

বাংলাদেশের হেড কোচ হাথুরুসিংহেও বললেন, “এ পর্যন্ত আমরা টুর্নামেন্টে যতগুলো উইকেটে খেলেছি তার মধ্যে নি:সন্দেহে এটাই সবচেয়ে ব্যাটিং সহায়ক উইকেট।”

পুনে শহরের উপকণ্ঠেই পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সহ্যাদ্রি রেঞ্জ শুরু হয়ে যায়, এই মাঠের চারপাশেও ঘিরে আছে সহ্যাদ্রির অনুচ্চ পাহাড়।

সেই পাহাড়-ঘেরা পুনের মাঠে এই ম্যাচে পাহাড়প্রমাণ রানের খেলা হবে, এমনটাই তাই আশা করছেন দু’দেশের ক্রিকেট-ভক্তরা।

বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ওপেনার তামিম ইকবালের সঙ্গে পুনের এই মাঠের একটা অন্য রকম সম্পর্ক আছে, যদিও তা খুব সুখকর বলা যাবে না।

২০১২ ও ২০১৩র আইপিএল মরশুমে, মানে আজ থেকে দশ-বারো বছর আগে পরপর দু’বার তামিমকে সই করিয়েছিল পুনের অধুনালুপ্ত ফ্র্যা্ঞ্চাইজি ‘পুনে ওয়ারিরর্স’।

কিন্তু তামিম একটি আইপিএল ম্যাচেও প্রথম এগারোতে খেলার সুযোগ পাননি – ফলে তার কেরিয়ার স্ট্যাটসেও আইপিএলের জায়গাটা ফাঁকাই রয়ে গেছে।

পুনে ওয়ারিরর্স টিমের ‘হোম গ্রাউন্ড’ ছিল এই স্টেডিয়ামটাই – ফলে এই মাঠে তাকে দিনের পর দিন ডাগ-আউটে বসতে হয়েছে, কিন্তু খেলার সুযোগ আসেনি।

আর যখন বিশ্বকাপে সেই মাঠেই বাংলাদেশ ভারতের বিরুদ্ধে খেলছে, তামিম স্কোয়াডেই নেই!

এবং যেহেতু একটার পর একটা ম্যাচে বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে, তাই বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুরাগীদেরও আরও বেশি করে মনে পড়ছে তামিমের কথা।

পুনেতে ম্যাচের আগের সন্ধেতেও হাথুরুসিংহের কাছে জানতে চাওয়া হল, “তামিমকে কি আপনারা মিস করছেন?”

বাংলাদেশের হেড কোচ কৌশলী উত্তর দিলেন, “ও তো এখানে নেই, তাই কী করে বলব ওকে মিস করছি কি না!”

“দুর্ভাগ্যবশত যখন আমরা টিম সিলেক্ট করছিলাম তখন ও প্রস্তুত ছিল না।“

আরও জানালেন, “প্লেয়ার হিসেবে ওর রেকর্ড নিশ্চয় ভাল, কিন্তু ওকে মিস করছি কি না সেটা তো বলতে পারব না – এখানে যারা আছে দলের ভাল ফলের জন্য তাদের ওপরই আমরা ভরসা রাখছি।“

বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট যে তামিম বিতর্ককে পেছনে ফেলে প্রাণপণে সামনের দিকে এগোতে চাইছে, তার কথায় সেটাও স্পষ্ট হয়ে গেল।

পুনের বিখ্যাত একটা খাবার হল ‘সেও-বাটাটা-দহি-পুরি’, যা অনেকটা দই-ওলা ফুচকার মতো খেতে।

শহরের ‘সুজাতা মস্তানি’ আইসক্রিম আর ঠান্ডা পানীয়রও খুব নামডাক।

পুনে-তে দুটো সিজন কাটানোর সুবাদে তামিম ইকবালও নিশ্চয় এই সব বিখ্যাত স্ট্রিট ফুড চেখে দেখেছেন!

তিনি সে সব আর আজ মিস করেন কি না কে জানে, তবে পুনের মাঠে খেলতে গিয়ে বাংলাদেশ দল কিন্তু তাকে মিস করতে পারছে না।

সোজা কথায় ব্যাটিংয়ের টপ অর্ডারের যা হাল, বাংলাদেশ তামিমকে ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারছে না!

এসএইচ-০১/১৯/২৩ (স্পোর্টস ডেস্ক)