কন্টেন্ট ক্রিয়েটাররা এখন ঝুঁকছেন ফেসবুকের দিকে

দেশে কন্টেন্ট ক্রিয়েটাররা আগে শুধুমাত্র ইউটিউব কেন্দ্রিক থাকলেও এখন তারা ঝুঁকছেন ফেসবুকের দিকেও। কেননা ইউটিউবে ভিউ বাবদ যেভাবে আয় করার সুযোগ থাকে, তেমনি ফেসবুকেও সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

সেইসঙ্গে বাংলাদেশে ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যমও হওয়ায় ভাল ভাল কন্টেন্ট ক্রিয়েটাররা খ্যাতিও পাচ্ছেন রাতারাতি।

কেননা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের অবসরে আর যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে মাধ্যমটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকে, সেটা নি:সন্দেহে ফেসবুক।

বাংলাদেশ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ৭২ লাখ ৪৫ হাজার। যা দিন দিন বাড়ছে। নানা ধরণের ভিডিও কন্টেন্ট এই বিপুল পরিমাণ ইউজারদের ফেসবুকের সাথে বেঁধে রাখছে ।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী মাইমুনা সুলতানার একটা বড় সময় কাটে এই ভিডিওগুলো দেখে।

“ফেসবুক এখন আর শুধু যোগাযোগের জায়গা নেই। এটা এখন এন্টারটেইনমেন্টের জন্যই বেশি ইউজ করি। আমার বেশি ভাল লাগে ফানি ভিডিও। আগে যেমন শুধু ইন্ডিয়া বা বাইরের অন্য কোন দেশের ভিডিও দেখতাম। এখন বাংলাদেশের কন্টেন্টগুলোই বেশি দেখি।”

“আমাদের কন্টেন্টগুলো বাইরের সাথে পাল্লা দিয়েই তৈরি করছে। তাই সেটা আমার অনেক ভাল লাগে। এটার কারণে সময় অনেক ভাল কাটে। ভাল বলতে কাজের সময়টাও কেটে যায়। কারণ ফেসবুকে অটো প্লেতে অন্য ভিডিওগুলো চলে আসে। ব্যাস চলতেই থাকে চলতেই থাকে,”- হাসতে হাসতে বলছিলেন মাইমুনা সুলতানা।

ফেসবুকে জনপ্রিয় কন্টেন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে ফানি ভিডিও, ফ্যাশন ভ্লগ, ট্রাভেলিং, ডিআইওয়াই, মিউজিক কভার, রান্নাবান্না অথবা শিক্ষণীয় নানা বিষয়।

তবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে ফেসবুকের ফানি ভিডিওগুলো। যেগুলো তৈরি করছেন বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরাই।

জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটার সালমান মুক্তাদির এতদিন ইউটিউবে ভিডিও পোস্টের জন্য পরিচিত হলেও ইদানিং তিনিও তার বিভিন্ন কন্টেন্ট প্রচার করতে ব্যবহার করছেন ফেসবুক।

আবার শিক্ষণীয় কন্টেন্ট তৈরির মাধ্যমে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন টেন মিনিটস্ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক।

বাংলাদেশে ফেসবুক বেশি জনপ্রিয় হওয়ায় শুরু থেকেই নিজের কন্টেন্টগুলো তিনি ফেসবুকে আপলোড করে আসছেন।

“বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষের কাছে ইন্টারনেট মানেই ফেসবুক। তার মানে এখানে অপারচ্যুনিটি (সুযোগ) অন্য যেকোন জায়গার চাইতে বেশি। ইদানিং সুবিধা আরও বেশি কারণ এ বছর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয়ের ব্যাপারটা যুক্ত হয়েছে। সেইসঙ্গে ভিডিওতে যেন ভিউ বেশি হয়, সেজন্য একটা ওয়াচ পেইজও এসেছে।”

“এজন্য এখন নতুন কন্টেন্ট ক্রিয়েটাররা কিন্তু ফেসবুকের দিকে ঝুঁকছে। স্টুডেন্ট লাইফে নিজের প্রিয় কাজ থেকে যদি একটা পকেট মানি আসে! তখন সে কিন্তু আরও ভাল কাজ করতে ইন্টারেস্টেড হয়। একটা ইন্সপিরেশ্যন পায়।”

একদম ভিন্ন রকম আইডিয়া নিয়ে রাতারাতি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটার অন্তিক মাহমুদ।

নিজের হাতে আঁকা কার্টুন অ্যানিমেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন গল্পের ধারা বর্ণনা দিয়ে তিনি তৈরি করেন একেকটি ভিডিও।

শুরুতে তিনি ইউটিউবের জন্য তৈরি করলেও এখন তিনি সেগুলো ফেসবুকেও বেশি করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বা বুস্ট করছেন। যা এখন তার বাড়তি আয়ের একটি বড় অংশ হয়ে উঠেছে।

“একসময় ইউটিউবেই সব কন্টেন্ট ক্রিয়েটাররা ছিল। এখন সবাই ফেসবুকে- দুইটা কারণে, এক তারা খুব তাড়াতাড়ি পরিচিতি পাচ্ছে আর দুই এখান থেকে টাকা আয় করা যাচ্ছে। ফেসবুকও কিছু বিষয়ে আগের চাইতে ইজি হয়েছে। আগে যেমন ইউটিউব ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করতে গেলে কপিরাইট চাইতো। এখন তারা পারমিশন দেয়।”

“এতে যেটা সুবিধা হয়েছে, সেটা হল অনেক আগে থেকে যারা কন্টেন্ট বানাচ্ছে তারা একে তো ইউটিউব থেকে ইনকাম করছে আবার ফেসবুক থেকেও টাকা পাচ্ছে। তো সে হিসেবে বলবো যে এখানে কন্টেন্ট ক্রিয়েটারদের জন্য একটা হিউজ পসিবিলিটি আছে। আপনি যদি টার্গেট করেন যে আপনি ফেসবুক থেকে ইনকাম করতে চান, তাহলে আপনি সেটা পারবেন,”- বলেন মিস্টার মাহমুদ।

নারী ভ্লগারদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় রাবা খান। স্ন্যাপচ্যাটের মতো আরও নানা মাধ্যমে তিনি এই ভিডিওগুলো তৈরি করেন।

যার পেছনে তেমন কোন খরচও করতে হয় না। উল্টে তিনি ভাল অংকের টাকা আয় করছেন। এ কারণে এই খাতকে বেশ সম্ভাবনাময় বলে তিনি মনে করেন।

“ক্রিয়েটিভ যারা আছেন তাদের জন্য এটা খুব ইজি। এবং চাইলেই তারা ফেসবুকে কন্টেন্ট আপলোড করে অনেক টাকা ইনকাম করতে পারে। আর এর জন্য সব সময় বড় ধরণের ইনভেস্টমেন্টেরও প্রয়োজন হয়না। এই আমার কথাই ধরেন। আমি শুধুমাত্র আমার স্মার্ট ফোন আর একটা লাইট ব্যবহার করি। এটাই আমার লাইফটাইম ইনভেস্টমেন্ট।”

“আপনার যেটা থাকা দরকার সেটা হল ক্রিয়েটিভিটি, মোবাইলটা ইউজ করতে জানা, ভিডিও এডিট করতে জানা, কোনটা ভাইরাল হবে, কোনটা হবে না সেটা বোঝা, মানে মার্কেটটাকে বোঝা। ব্যাস এতোটুকু থাকাটাই যথেষ্ট,” এমনটাই বলেন রাবা খান।

ফেসবুকে আগে একটি ভিডিও ভাইরাল করতে প্রতিটি পোস্ট বুস্ট করা বাবদ একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ খরচ করা লাগতো। কিন্তু এখন বিষয়টি উল্টো।

ভিডিওর ভিউয়ার সংখ্যা বাড়লে ইউটিউবের মতো বরং আয় করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষজ্ঞ মিনহার মোহসিন বলছেন, “আগে ফেসবুকে নরমালি ভিডিও দেখতাম। এখন ভিডিওর চলার মাঝখানে দশ সেকেন্ডের ননস্টপ একটা অ্যাড চলে আসে। এটাকে থ্রু প্লে বলা হয়।”

”এটার মাধ্যমে একজন ডিজিটাল মার্কেটার তার ক্লায়েন্ট থেকে কোন ভিডিও এনে সেটা প্রমোট করলো। যখন মানুষ কোন ভিডিও দেখবে তখন সেটার মাঝখানে এই অ্যাডগুলো চলবে।”

“এই ভাবে সেই ভিডিওগুলো কতবার ভিউ হল, এটার ওপর বেইস করে ফেসবুক একটা চার্জ রাখে। আর যেহেতু একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটারের একটা ভিডিওর ভেতরে অ্যাড যাচ্ছে, সেই অ্যাডের একটা পার্সেন্টেজ ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কন্টেন্ট ক্রিয়েটাররাও পেয়ে যায়।”

একটা ফেসবুক পেইজে তিন লাখ ভিডিও ভিউ হলেই সেই পেইজটা মনিটাইজেশনের জন্য অর্থাৎ আয়ের জন্য উপযুক্ত হয়।

এই থ্রু-প্লে আসার পরে ফেসবুকে ভিডিও বানানোর হার অনেক বেড়ে গেছে বলে জানান মিস্টার মোহসিন।

ভারতসহ বিভিন্ন দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফেসবুক ভিডিও থেকে রোজগারের উপায় তৈরি করা হলেও বাংলাদেশে এখনও এটি সেরকম কোন শিল্প হয়ে গড়ে ওঠেনি।

বাংলাদেশে প্রথম সারির কন্টেন্ট ক্রিয়েটাররা বলছেন এখন অসংখ্য কন্টেন্ট তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মান ও রুচিসম্মত কন্টেন্ট তৈরি করতে না পারায় অনেকের কাজই স্বীকৃতি পাচ্ছে না।

এসএইচ-০৭/১৭/১৯ (সানজানা চৌধুরী, বিবিসি)