ইউনিয়ন পর্যায়েও উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড

Network switch and ethernet cables,Data Center Concept.

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি ইউনিয়নে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে যাচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় ৩৬শ ইউনিয়ন ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবলের মাধ্যমে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় এসেছে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) পৃথক দুই প্রকল্পের মাধ্যমে ইউনিয়ন সেন্টারগুলোতে এ সংযোগ পৌঁছেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ইউনিয়ন সেন্টারসহ কিছু সরকারি অফিসে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের এই সেবা ব্যবহৃত হচ্ছে। আর গ্রাহক পর্যায়ে বা ঘরে ঘরে এই ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিতে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এখনো পরিকল্পনা তৈরি করছে। আর ইউনিয়ন সেন্টারের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটকে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সংশ্লিষ্টরা।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ইউনিয়ন পর্যায়ে দ্রুত গতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিতে জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অবকাঠামো উন্নয়ন (ইনফো সরকার তৃতীয় পর্যায় বা ইনফো সরকার-৩) শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটির আওতায় ২৬০০ ইউনিয়নকে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের আওতায় আনার লক্ষ্য রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে ১০০০ অফিসে ডাটা কানেক্টিভিটি ও ১৬০০ অফিসে ভিপিএন/এমপিএলএস সেবা দেওয়াও এই প্রকল্পের লক্ষ্য। প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত।

ইনফো সরকার-৩ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে দেশের প্রায় ৮০ ভাগ ইউনিয়নে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মাধ্যমে পৌঁছে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২৬০০ ইউনিয়নের মধ্যে ২৩৫৭টি ইউনিয়নে নেটওয়ার্ক মনিটর ইন্টিগ্রেটেড করা হয়েছে। প্রকল্পের এ অংশে অগ্রগতি ৯০ শতাংশ। অন্যদিকে ২৪৭৭ ইউনিয়নে যন্ত্রপাতি, ইকুইপমেন্ট ইনস্টল করা হয়েছে, যেখানে আগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। এক হাজার পুলিশ স্টেশনে ভিপিএন কানেশন দেওয়াও এই প্রকল্পের লক্ষ্য। এর মধ্যে ৯৬৫টি পুলিশ অফিসকে এই নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাকি ইউনিয়ন সেন্টারগুলোতে সংযোগ দেওয়া ও গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে বর্তমানে কাজ চলছে।

ইনফো সরকার-৩ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক বিকর্ণ কুমার ঘোষ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রকল্পের লক্ষ্য অনুযায়ী প্রায় ২৪শ ইউনিয়নে আমরা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দিয়েছি। বাকি দুইশ ইউনিয়নের মধ্যে দেড়শ ইউনিয়নে যন্ত্রপাতি এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে। প্রকল্পটি শেষের পথে। ডিপিপির ৯০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। আমাদের টার্গেট শতভাগ কাজ শেষ করা। আশা করছি জুনে কাজ শেষ হবে।’

এদিকে, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) অন্য এক প্রকল্পের মাধ্যমে ১২১৬টি ইউনিয়ন সেন্টারে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে। বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. রফিকুল মতিন সারাবাংলাকে বলেন, আমরা ১২১৬টি ইউনিয়ন সেন্টারকে উচ্চগতির ইন্টারনেটের আওতায় এনেছি। এসব সেন্টারে গিয়ে সাধারণ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে।

বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে চার হাজারের মতো ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এরই মধ্যে ৩৬১৬টি ইউনিয়ন সেন্টার বা ৮০ ভাগ ইউনিয়নে উচ্চগতির ইন্টানেট সেবা পৌঁছে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইনফো-সরকার প্রকল্পের আওতায় সংযোগ পাওয়া ইউনিয়ন সেন্টারগুলোর কার্যক্রম এখন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটেই চলছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পর্যায়ের সরকারি কিছু অফিসে ওয়াইফাইয়ের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে ইউনিয়ন সেন্টারে উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছালেও গ্রাহক পর্যায়ে এই সেবা কবে উন্মোচিত হবে, সুস্পষ্ট করে তা বলতে পারছেন না কেউ। তারা বলছেন, গ্রাহক পর্যায়ে সেবা পৌঁছে দিতে নীতিমালা তৈরির কাজটি মাত্র শুরু হয়েছে।

একই কথা প্রযোজ্য বিটিসিএলের প্রকল্পের ক্ষেত্রেও। প্রকল্পটির আওতায় ১২শ ইউনিয়নে ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার কাজ গেল বছরই শেষ হয়েছে। তবে ওইসব সেন্টার থেকে এখনো গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন বিটিসিএলের কর্মকর্তারা। ওইসব ইউনিয়ন সেন্টার থেকে গ্রাহক পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার কোনো পরিকল্পনার বিষয়ে বলতে পারেননি সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকও।

তথ্যপ্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহক পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ না পৌঁছানো পর্যন্ত ইনফো সরকার-৩ প্রকল্পের কোনো সুফল মিলবে না। কেননা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার কারণেই এখনো গ্রামের তরুণরা তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত হতে পারছেন না।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, উপজেলা বা ইউনিয়ন সেন্টার পর্যন্ত ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল থাকলেই হবে না, এটাকে গ্রাহক পর্যায়ে ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। বাড়ি বাড়ি ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে হবে। আমরা যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের কথা বলছি, সেটি কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের তরুণ-তরুণীরা এখনো উচ্চ গতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারছে না। তারা ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত হতে পারছে না। আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে আমরা কোনো প্রকল্প বা টেন্ডারও দেখছি না। ডিজিটাল বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে এ প্রক্রিয়াটি দ্রুত শেষ করতে হবে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউনিয়ন পর্যায়ে ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল পৌঁছালেও গ্রাহকের কাছে কিভাবে এই ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছাবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো রূপরেখা তৈরি হয়নি। কারা এই সংযোগ পৌঁছাবে, কিভাবে পৌঁছাবে— এসব বিষয় নিয়ে সবেমাত্র পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। কবে নাগাদ পরিকল্পনা শেষে গ্রাহক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পাবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

ইনফো সরকার-৩ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক বিকর্ণ কুমার ঘোষ বলেন, ‘আমাদের প্রকল্পে ১০ কোটি মানুষ উপকারভোগী হবে। কিন্তু কেবল অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগই বড় কথা নয়, এর সার্ভিস ডেলিভারির একটি মডেলও তৈরি করতে হবে, যেন ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের আওতায় আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে সেবা দেওয়া হবে। তারা সার্ভিস ডেলিভারি ও রিপেয়ার করবে। গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ কিভাবে দেওয়া যায়, সে বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে।’

বিকর্ণ কুমার ঘোষ বলেন, ‘ইউনিয়ন সেন্টার থেকে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দিতে বুয়েটের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। তারা এজন্য ফিজিক্যাল স্টাডি করছে। এর প্রাথমিক একটি প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। আগামী একমাসের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। মডিউল ঠিক হলে আমরা ওপেন টেন্ডারে যাব, তাদের অবশ্যই ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) প্রতিষ্ঠান হতে হবে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিসিসি’র চুক্তি হবে। অর্থাৎ গ্রাহক পর্যায়ে সেবা পৌঁছে দিতে আমাদের কাজ চলছে।’

এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রান্তিক পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার কাজটি প্রধানত বেসরকারি খাতকে করতে হবে। এখনো গ্রাম পর্যায়ে সেটি লাভজনক না হওয়ায় তারা এগিয়ে আসছে না। তৃণমূল পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টানেট পৌঁছে দিতে সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রকল্প চলছে। বিটিসিএল থেকে একাধিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ৫৭৮টি ইউনিয়নে ফ্রি ওয়াইফাই জোন করে দেওয়া হয়েছে। আরও ৭৩৬টি ইউনিয়নে কানেক্টিভিটি পৌঁছাতে প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০২১-২২ সাল নাগাদ দেশের কোনো অঞ্চলই উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে থাকবে না।’

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘বর্তমানে প্রায় ৩৮০০ ইউনিয়ন ব্রডব্যান্ডের ইন্টারনেটের আওতায় এসেছে। বাকি ৭০০ ইউনিয়নকেও উচ্চ গতির ইন্টারনেটর আওতায় আনার কাজ চলছে। লোকাল আইএসপি সার্ভিস প্রোভাইডারের মাধ্যমে ওইসব সেন্টার থেকে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার লক্ষ্যেও কাজ চলছে। প্রতিটি ইউনিয়ন সেন্টারে ২০০ কানেক্টিভিটির সুযোগ রাখা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ইউনিয়ন সেন্টার থেকে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’

এদিকে, টেলিসেবা পৌঁছে দেওয়া কঠিন— এমন দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে বিটিসিএল আরও একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে হটস্পট ও ওয়াইফাইয়ের মাধ্যমে ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া হবে।

বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল মতিন বলেন, ‘এখন আমরা অন্য আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ৪০০টি টেলিসেবা-দুর্গম এলাকায় হটস্পট ও ওয়াইফাই বসাব। প্রান্তিক জনগণকে ইন্টারনেট সেবা দেবে এই প্রকল্প। বাজার, স্কুল, কলেজ ও জনসমাগম হয়— এমন স্থানে ওয়াইফাই দেওয়া হবে। দুই বছর পর্যন্ত বিনামূল্যে সাধারণ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে।’

এসএইচ-০৭/১২/২০ (প্রযুক্তি ডেস্ক)