কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বাংলা ভাষা শেখাচ্ছেন যারা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স আজকাল অনেক পরিচিত শব্দ। প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে শুরু করে শিক্ষা, গবেষণা ও অর্থনীতিতে দিন দিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়ছে। বলা হচ্ছে, আগামীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এই আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই পরিচালিত হবে।

দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার রয়েছে। অনেকেই কম্পিউটার কিংবা মোবাইল ফোনে থাকা গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্যে বাংলা থেকে ইংরেজি কিংবা ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করে নেন। এটিও সম্ভব হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে।

কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায়, এই রূপান্তরটি ঠিক শুদ্ধ হচ্ছে না। এর কারণ, কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাংলা ভাষার সব ধরনের শব্দ ও উচ্চারণের সঙ্গে পুরোপুরি পরিচিত নয়। আঞ্চলিক শব্দ ও উচ্চারণ অনেক সময়ই বুঝতে পারে না। বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে বাংলায় অনেক ডায়ালেক্ট এবং উচ্চারণ পদ্ধতি রয়েছে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বাংলা ভাষায় সমৃদ্ধ করা এতটা সহজ কোনো কাজ নয়।

আর এই কঠিন কাজটি সহজ করতে এগিয়ে এসেছেন দেশের একদল মেধাবী তরুণ প্রযুক্তিবিদ। যাদের রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের ওপর বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা ও কাজের অভিজ্ঞতা।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির একদল মেধাবী শিক্ষার্থীর হাত ধরে জন্ম নেয় বেঙ্গলি এআই। স্বেচ্ছাসেবী এ প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ অলাভজনক। সংস্থাটি ব্যক্তিগত এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুদানে চলে। বর্তমানে ছয় হাজার আন্তর্জাতিক গবেষকের একটি বিশাল প্ল্যাটফর্ম বেঙ্গলি এআই।

বাংলা ভাষায় দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভান্ডারে যোগ করাই বেঙ্গলি এআই-এর উদ্দেশ্য। এর জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজনীয় মেশিন লার্নিং ডেটাসেট তৈরি করছে। যার মাধ্যমে বাংলা ভাষার সঙ্গে আরও ভালোভাবে পরিচিত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

এই ডেটাসেট তৈরির প্রয়োজনে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ডায়ালেক্টের বাংলা ভাষার উচ্চারণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বকবক নামের একটি ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে বেঙ্গলি এআই। বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো বাংলাভাষী তাদের ভয়েস ডেটার মাধ্যমে এই গবেষণা উদ্যোগে অংশ নিতে পারবেন। এ জন্য তাদের https://commonvoice.mozilla.org/bn/speak লিংকে থাকা নিয়মাবলি অনুসরণ করতে হবে।

এরই মধ্যে ২৪ হাজার বাংলাভাষী মানুষের কাছ থেকে ২ হাজার ঘণ্টার ভয়েস ডেটা সংগ্রহ করেছে বেঙ্গলি এআই দল। যেখানে রয়েছে বাংলাদেশের সব অঞ্চল ও সব ধরনের উচ্চারণের নমুনা। বর্তমানে তাদের টার্গেট ১০ হাজার ঘণ্টার ডেটাসেট সংগ্রহ করা।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বাংলা ইশারা ভাষাকে পরিচিত করাও বেঙ্গলি এআই-এর অন্যতম মিশন। এর মধ্য দিয়ে যেসব বাংলাভাষী কথা বলতে পারেন না, তারাও সহজেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা নিতে পারবেন। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে বাংলা ভাষার পুরোনো দলিলপত্রকে সহজবোধ্য করার কাজও বেঙ্গলি এআই-এর মেধাবী গবেষকরা শুরু করেছেন।

বাংলা কথাকে বাংলা লেখায় পরিণত করতে এ পর্যন্ত অংশ নিয়েছেন ২৪ হাজার মানুষ। মূলত ফেসবুকের মাধ্যমেই এ প্রচারণাটা চালিয়েছেন তারা।

নিজেদের তৈরি করা এসব ডেটাসেটকে কোনো পণ্য হিসেবে বিক্রি করছে না বেঙ্গলি এআই। এগুলো সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে পাওয়ার সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুদানের ওপর ভর করে বেঙ্গলি এআই-এর সব খরচ চলে। পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার দেয়া অনুদানও নিচ্ছে বেঙ্গলি এআই।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অবস্থানরত বেঙ্গলি এআই প্রধান আহমেদ ইমতিয়াজ হুমায়ুন জানান, প্রথম থেকেই তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন কোনো বিষয় নিয়ে গবেষণা কিংবা কাজ করা, যেটি বাংলাদেশের কাজে লাগবে। সেই উদ্দেশ্য থেকেই বেঙ্গলি এআই-এর এ উদ্যোগ।

তিনি বলেন, বেঙ্গলি এআই-এর অনেক সদস্য বুয়েট ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। যার খরচ চলে বাংলাদেশের মানুষের টাকায়। তাই শুরু থেকেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে উপকৃত করার প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন তারা। শুধু বাংলাদেশের মাটিতেই নয়, বিদেশের মাটিতে থেকেও তাদের মেধাকে বাংলাদেশের প্রয়োজনে কাজে লাগাবেন তারা।

বেঙ্গলি এআই-এর কো-অর্ডিনেটর আসিফ সুস্মিত সময় সংবাদকে বলেন, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে অর্থনীতি ও শিক্ষা পৃথিবীর সব খাতেই এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলাদেশের অনেকেই প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারেন না। এমনকি লিখতে বা পড়তেও জানেন না। সে ক্ষেত্রে তারা যখন মোবাইল ফোন কিংবা গুগল সার্চের মতো টেকনোলজি ব্যবহার করতে যান, তারা সমস্যার মুখোমুখি হন। এসব মানুষের কাছে টেকনোলজির সুবিধাকে সহজ করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

এ ব্যাপারে চীনের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চীনা ভাষার আত্তীকরণ এতটাই ভালো হয়েছে যে অনেক যন্ত্রপাতি এবং টেকনোলজি চীনা ভাষায় কমান্ড দেয়া হলে খুব ভালোভাবে সাড়া দেয়। চীন যে প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে গেছে তার পেছনে এটিও একটি বড় কারণ। যারা শুধু বাংলা ভাষাই বলতে ও বুঝতে পারে, এমনকি প্রমিত উচ্চারণ জানেন না, যখন কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভালোভাবে বাংলা ভাষাকে বুঝতে পারবে, তখন এসব মানুষকে আমরা টেকনোলজির সুবিধার খুব কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারব।’

বেঙ্গলি এআই-এর চিফ ও কো-প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর হিসেবে রয়েছেন বুয়েটের ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের রাইস ইউনিভার্সিটির পিএইচডিরত আহমেদ ইমতিয়াজ হুমায়ুন।

কো-অর্ডিনেটর হিসেবে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রেনসিলিয়ার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পিইএইচডি শিক্ষার্থী আসিফ সুস্মিত। তিনিও বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী।

অপর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও কো-প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর তাহসিন রিয়াসাত যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যানডার বিল্ট ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক।

কো-প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর হিসেবে রয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ফারিগ সাদেক।

এ ছাড়াও এই দলে রয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন দক্ষ ও মেধাবী প্রযুক্তিবিদ ও গবেষক। যাদের রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ভাষাতত্ত্বের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা এবং প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা।

এসএইচ-২৯/২৬/২২ (প্রযুক্তি ডেস্ক)