বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বৈঠক

একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের আজ ষষ্ঠদশ দিন। একাত্তরের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের বৈঠক হয়। বৈঠকে পাকি প্রেসিডেন্টের সামনে বাঙালীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ এবং হত্যাকান্ডে ক্ষোভে ফেটে পড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু দ্রুত সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং সকল হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেন।

সকাল পৌনে ১১টার দিকে ঢাকার ধানমন্ডি বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্দেশে রওনা হন, তখন পুরো রাস্তায় মুক্তিপাগল বাঙালীদের স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত রাজপথ। পুরো পথেই বাঙালীরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত রাখে। মাঝে মাঝে থেকে বঙ্গবন্ধুও জয় বাংলা বলে তাঁর কর্মী, সমর্থক ও ভক্তদের অনুপ্রেরণ দেন। তখন বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে উড়ছিল কালো পতাকা। বাঙালী হত্যার প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে সাদা মোটরগাড়িতেই কালো পতাকা উড়িয়েই প্রেসিডেন্ট ভবনে যান বঙ্গবন্ধু। পাকি প্রেসিডেন্ট নিজেই বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগেই পূর্বাশর্তারোপ করে বলেছিলেন, বৈঠক হবে ‘ওয়ান টু ওয়ান’। পাক প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুর সেই শর্ত মেনে নিয়ে তাঁর সঙ্গে সকাল ১১টায় একাকী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন। সংসদীয় ক্ষমতার অধিকার এবং পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, যার অঙ্গুলি হেলনে পুরো দেশটি চলছে, সেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেন পাকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। বৈঠক শেষ হলেও দু’পক্ষই ছিলেন নিশ্চুপ।

তখন বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় দেশী-বিদেশী প্রচুর সাংবাদিক। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিছিল করছেন বীর বাঙালীরা। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে প্রধান ফটকের সামনে পৌঁছলে সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় থাকা দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও আলোকচিত্রিরা তাঁর গাড়ি ঘিরে ধরেন। প্রথমে কিছুই বলতে চাননি বঙ্গবন্ধু। পরে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় গাড়ি থেকে নেমে এসে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।

বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা দু-এক মিনিটের বিষয় নয়। এ জন্য সময়ের দরকার। আলোচনা চলছে, কাল সকালেও আবার বৈঠকে বসব। এর চেয়ে বেশি আমার বলার নেই। নানা প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু শুধু এটুকু বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমি রাজনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি এবং বাস্তবতা তুলে ধরেছি।’

প্রায় আড়াই ঘণ্টার বৈঠকে কী হলো? পাকি প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুর সব দাবি মেনে নেবেন, না কী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেই আদায় করতে হবে সব দাবি? এসব প্রশ্নের কোন কূল-কিনারা পাচ্ছিলেন না রাজপথে নেমে আসা মুক্তিপাগল বীর বাঙালীরা। কিন্তু সবাই এটুকু নিশ্চিত বুঝে গেছেন, স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু একচুলও নড়বেন না। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি ধানমন্ডির বাসভবনে ফিরে যান বঙ্গবন্ধু।

ধানমন্ডির বাসভবনে সকাল থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীরা। বাসায় ফিরেই বঙ্গবন্ধু নেতাদের সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় বসেন। গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠকটি চলে। দু’দফা বৈঠকে বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের পাকি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়বস্তু, অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি পরের দিনের বৈঠকের কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন।

বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়েই ইয়াহিয়া খান বুঝতে পারেন এ দেশটিতে কোনই নিয়ন্ত্রণ নেই তাদের। একমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া পুরো দেশই চলছে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে। এমনকী প্রেসিডেন্ট ভবনের বাঙালী কর্মচারীরাও পাকিদের কোন কথা শুনছে না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন ইয়াহিয়ার বৈঠক চলছিল, স্বাধীনতার প্রশ্নে পুরো পূর্ব পাকিস্তানই তখন উত্তাল।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে চলা অসহযোগ আন্দোলনে পুরো দেশই কার্যত অচল। বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ অনেক আগেই হারিয়ে ফেলে পাক হানাদাররা। দেশের কোথাও চাঁনতারা খচিত পাকিস্তানের পতাকা নেই। বরং পুরো বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়, শহরে-বন্দরে পতপত করে উড়ছে রক্তস্নাত মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের পতাকা।

সামরিক জান্তার কোন আদেশ-নির্দেশই মানছে না বীর বাঙালী। তবে পাকিদের গোপন উদ্দেশে বাঙালীদের সামনে ধরা পড়ে খুব অল্প সময়েই। বৈঠকটির আড়ালে বাঙালীদের আন্দোলন বুলেটের মাধ্যমে দমনের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র-গোলাবারুদ আনা হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানে। এটা দেখে চুপ করে বসে ছিল না মুক্তিপাগল বাঙালী। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিষয়টি আঁচ করতে পেরে গোপনে সারাদেশেই অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহের মাধ্যমে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

সারাদেশের অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ বন্ধ। সব সরকারী ভবন, হাটবাজার এমনকী পাড়া-মহল্লায়ও উড়ছে প্রতিবাদের কালো পতাকা। কোথাও কোথাও বাংলাদেশের নতুন পতাকাও উড়তে থাকে। মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। সব বয়স সব পেশা ও শ্রেণীর মানুষ বেরিয়ে আসতে থাকে রাজপথে। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বঙ্গবন্ধুকে আরও উজ্জীবিত করতে রাস্তায়, মাঠে-ময়দানে তখন গণসঙ্গীত, নাটক, পথনাটক ও পথসভা করে চলছে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বেতার-টেলিভিশন শিল্পী সংসদ, মহিলা পরিষদ প্রভৃতি সংগঠন। হাইকোর্টের আইনজীবী, বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করতে থাকেন।

 এসএইচ-০১/১৬/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)