বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় দফা বৈঠকে বসেন পাকি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে

১৭ মার্চ, ১৯৭১। “সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম/ চলবেই দিনরাত অবিরাম”- এ রকম অনেক উদ্দীপনামূলক গান টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে। সে ছিল আশ্চর্য এক জাগরণের কাল। সকল বাঙালীর চেতনা স্থির ছিল একটি মাত্র লক্ষ্যবিন্দুতে- যার নাম স্বাধীনতা। একাত্তরের উত্তাল এই দিনে পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। খোদ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করে নিশ্চিত হন এ অংশে কার্যত পাকিস্তানের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনেই চলছে সবকিছু। স্বাধীনতার প্রশ্নে বীর বাঙালীর অকুতোভয় সংগ্রাম আর রণপ্রস্তুতিতে পাক প্রেসিডেন্টের বুঝতে বাকি থাকে না পাকিস্তানের অখ-তা আর রক্ষা করা সম্ভব নয়।

তাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণের পথ নেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। প্রতিটি বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালীর মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীন। ফলে পাকি সামরিক জান্তারা ভেতরে ভেতরে বাঙালী নিধনযজ্ঞ চালিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামকে ভন্ডুল করার জঘন্য পরিকল্পনা আঁটতে থাকে। প্রতিদিনই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ করা হয় বাংলাদেশে।

একাত্তরের ১৭ মার্চ ছিল বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২তম জন্মদিন। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মিছিল করে ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে গিয়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। সেদিন দুপুরে ঢাকার ধানমন্ডির বাসভবনে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে আসা স্বাধীনতাকামী বাঙালীর উদ্দেশ্যে জন্মদিনের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কামনা জনগণের সার্বিক মুক্তি।’

একাত্তরের এই দিন সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হন পাকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। বৈঠক প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। কড়া সামরিক প্রহরায় প্রেসিডেন্ট ভবনে এই বৈঠক হয়। এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তৃতীয় কেউ উপস্থিত ছিলেন না। বৈঠক শেষে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধুৃ বলেন, আলোচনা এখনও শেষ হয়নি। তবে আলোচনার পরবর্তী সময়ও ঠিক হয়নি। আলোচনা চলছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। এর বেশি আর কিছু আমার বলার নেই।

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পর বঙ্গবন্ধু সরাসরি তাঁর বাসভবনে ফিরে যান। নেতার গাড়ি বাসভবনে দিকে যাওয়ার সময় রাস্তার দু’পাশে অপেক্ষমাণ জনতা ও পথচারীরা- ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি দিতে থাকেন। সাংবাদিকরাও বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে তাঁর বাসভবন গিয়ে পৌঁছান। বাসভবনে পৌঁছানোর পর দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে এক ঘরোয়া আলোচনায় মিলিত হন।

এ সময় জনৈক বিদেশী সাংবাদিক বাংলাদেশের নেতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে জানতে চান, আজ ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় কামনা কী? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, জনগণের সার্বিক মুক্তি। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনে মোমবাতি জ্বালাই না, কেকও কাটি না। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী! আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু। আপনারা জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোন মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আজকের বৈঠক প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বলেন, আলোচনা চলবে।

বৈঠকে তাঁর চার দফা পূর্বশর্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি-না জানতে চাওয়া হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছি। আমি যখন আলোচনা করি অবশ্যই আমার দাবির কথাও বলি। আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছে কি-না প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছে, না নিরর্থক হচ্ছে জানি না। তবে জন্মদিনের শুভেচ্ছার জবাবে বঙ্গবন্ধু যে বাঙালীর মুক্তির কথা বলেছিলেন, ঠিকই তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিপাগল বাঙালী পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার লালসূর্য। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু বাঙালীর মুকুটমণি, জাতির পিতা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

এসএইচ-০১/১৭/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)