সংগ্রামের উত্তাল ঢেউ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছিল

২৩ মার্চ, ১৯৭১। আন্দোলন, সংগ্রামের উত্তাল ঢেউ ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে শহর থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছিল। ঢাকা নগরীও এদিন মিছিলে মিছিলে গর্জে উঠেছিল। একাত্তরের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস হিসেবে পালনের কথা থাকলেও সেদিন তা হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ এদিন পালন করেছে বাংলাদেশ দিবস হিসেবে।

একাত্তরের এই দিন সকালে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের সামরিক কায়দায় অভিবাদন গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তাঁর ৩২ নম্বর ধানম-ির বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ উদ্দীপক গানটি সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয়।

একাত্তরের মার্চের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলন চলছিল পুরোদমে। সারাদেশেই এই অসহযোগ আন্দোলন পালিত হচ্ছিল। অপরদিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৈঠকে সমাধান হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা না গেলেও কুচক্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এ বৈঠককে ‘উৎসাহব্যঞ্জক বৈঠক’ বলে অভিহিত করেন।

আজ পাকিস্তান দিবসে ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন ও সেনাবাহিনীর সদর দফতর ছাড়া বাংলাদেশে আর কোথাও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়েনি। সারা বাংলায় অর্ধচন্দ্র তারকাখচিত সাদা-সবুজ পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে উড়েছে সবুজ জমিনের মাঝে লাল সূর্যের ওপর বাংলাদেশের সোনালি রং মানচিত্র শোভিত স্বাধীন বাংলার পতাকা।

ঢাকাস্থা ব্রিটিশ হাইকমিশন ও সোভিয়েত কনস্যুলেটে পাকিস্তানী পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হয়। চীন, ইরান, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ায় দূতাবাস ভবনে প্রথমে পাকিস্তানী পতাকা তোলা হয়। পরে জনতা এসব দূতাবাসে সেই পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তোলে। মার্কিন দূতাবাসে আজ কোন পতাকাই তোলা হয়নি।

ইয়াহিয়া খান এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিদিনের বৈঠকগুলো চলছিল কড়া নিরাপত্তার মধ্যে। যার ফলে বৈঠক সম্পর্কে চারদিক রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছিল। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে এ সময়ের বৈঠক নিয়ে নিবন্ধও লেখা হয়। দিন যত যেতে থাকে বাঙালীরা ঠিকই বুঝতে পারে যে আলোচনায় কোন ফলাফল আসবে না। তাই তারা প্রস্তুতি নিতে থাকে। অপরপক্ষে পাকিস্তানী স্বৈরাচার সরকারও তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যায়। প্রতিদিন গোপন বৈঠক করে সামরিক জান্তারা বাঙালীর ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে।

সমস্ত শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে একেকটি মিছিল এসে মিশে যাচ্ছিল আরও অনেক মিছিলের সঙ্গে। ঢাকা শহর এদিন মিছিলের নগরীতে রূপ নেয়। সারাদেশে আন্দোলনের ঢেউ ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ একাত্তরের ২৩ মার্চ ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে।

এ উপলক্ষে ঢাকায় ছিল গণআন্দোলনের প্রবল জোয়ার। রাজপথে লাঠি, বর্শা, বন্দুকের মাথায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ছিল উচ্চকিত। জনতা ভুট্টো ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধেও স্লোগানে দেয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি, ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর কুশপুতুলদাহ করে বিক্ষুব্ধ বাঙালী।

কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও বাঙালী প্রাক্তন সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত ‘জয় বাংলা বাহিনী’র আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ ও মহড়া আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। জয় বাংলা বাহিনীর পাঁচ শতাধিক সদস্য প্যারেড করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান। ১৯৭১-এর এই দিনেই স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পল্টন ময়দানে জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজের মাধ্যমে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন এবং মিছিল করে পল্টন হতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পৌঁছে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে নূর এ আলম সিদ্দিকী স্বাধীন বাংলার পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

 এসএইচ-০১/২৩/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)