বিশ্বকাপের ‘মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার’ সাকিব!

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার পর থেকেই অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়ে রাজত্ব করে আসছেন বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান। ১২ বছরের ক্যারিয়ারে বাংলাদেশের হয়ে অনেক কিছু অর্জন করলেও বিশ্বকাপে এবারের সাকিব যেন আগের চেয়ে পুরোপুরি আলাদা। কেননা, সাকিবে ভর করেই যে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন দেখছে টাইগাররা।

বিশ্বকাপে এখনো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগ পর্যন্ত চার ম্যাচ খেলে টানা দুই সেঞ্চুরিসহ ৩৮৪ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকে তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছিলেন সাকিব অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে সাকিবকে ছাড়িয়ে যান অ্যারোন ফিঞ্চ এবং ডেভিড ওয়ার্নার।

তবে বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড় দৌড়ে সবার চেয়েই এগিয়ে রয়েছেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার। তবে ইংল্যান্ড ভিত্তিক বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম টেলিগ্রাফ বলেই দিয়েছে যে এই বিশ্বকাপের বিতর্কহীনভাবে সেরা খেলোয়াড় বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান।

সাকিবকে নিয়ে লেখা একটি প্রতিবেদনে তার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছে বিখ্যাত ওই সংবাদ মাধ্যমটি। সেটিই তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের কাছে-

এ বছর বিশ্বকাপে খেলা ১৫০ জন ক্রিকেটারের মধ্যে মাত্র একজনই আছেন, যিনি তার দেশের সেরা ব্যাটসম্যান এবং সেরা বোলার। তার নাম সাকিব আল হাসান, বিতর্কিতহীনভাবে এখনো পর্যন্ত ২০১৯ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়।

বাকি ক্রিকেট বিশ্বে সাকিবকে একটু নিচু করে দেখার প্রবণতা আছে। ব্যাপারটা কৌতুহল জাগানিয়া। কেননা, তিনি যাদের সঙ্গে বা বিপক্ষে খেলেছে তাতে কোনমতেই তাকে নিচু করে দেখা যায় না। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের উত্থান, আইপিএলে অসাধারণ প্রত্যাবর্তন কিংবা ২০১৫ সালে সব ফরম্যাটে আইসিসি অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়ে একনম্বর হওয়া সব কিছুই ভক্তরা দেখেছে।

তবে সাকিবকে নিচু করে দেখার ক্ষেত্রে একটা কঠিন সত্য কথা বলে; কারণ তিনি কোনো বড় দলের খেলোয়াড় নন। যাতে করে, তার প্রতিভা খুব সহজেই যে কারও নজরে পড়ে না। বাস্তবতা এটাই যে অস্ট্রেলিয়া মতো বড় দল ২০১১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের বিপোক্ষে মাত্র একটাই ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে।

২০০০ সালে যখন সাকিবের বয়স ১৩ বছর, তখন দুটি ঘটনা বাংলাদেশ ক্রিকেটকে বদলে দিয়েছিল। প্রথমত, স্বাধীনতার ২৯ বছর পর টেস্ট খেলার মর্যাদা লাভ। কারণ, ক্রিকেট সবসময়ই বাংলাদেশের মানুষের শিকড়ে বাধা ছিল। পাকিস্তানের অধীনে থাকার পরও তারা টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে তাদের অবকাঠামো উন্নয়ন করে নিয়েছে এবং নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন করে পুরো দেশে এই খেলাকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি যত কঠিনই হোক পথচলা, তবুও দেশটিতে ক্রিকেট এগিয়ে চলছে।

২০০০ সালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাকিবের জায়গা পাওয়া। বাংলাদেশের মাগুরায় বড় হওয়া এই ছেলেটির ছোটবেলা থেকেই লড়াই করার মানসিকতা ছিল। বিকেএসপিতে সুযোগ পেয়ে সাকিব সেখানেই পড়াশুনা এবং বসবাস করতে থাকে। নিজের দক্ষতাকে মজবুত করার জন্য যে সুযোগ সুবিধা এবং অনুশীলন দরকার তা নিয়ে নিজের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বীতা গড়ে তোলেন সাকিব। তার এ যাত্রায় কোচ এবং মেন্টরসদের বিশ্বাসযোগ্য পাত্র হয়ে ওঠেন তিনি।

এর ছয় বছর পর সাকিবের যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হলো, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৯। বাংলাদেশ টানা ৪৫ (৪৭) ওয়ানডে ম্যাচ হারার মাত্র দুই বছর পরেই দলে প্রবেশ করেন তিনি। সাকিব তার সহজাত ব্যাটিং, বোলিংয়ে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ এবং ভয়-ডরহীন খেলার জন্য দলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই অপরিহার্য একজন সদস্য হয়ে গিয়েছিল।

২০০৩ বিশ্বকাপে কানাডা এবং কেনিয়ার কাছে হেরেছিল বাংলাদেশ; তবে ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারাতে সাকিবের ৫৩ রান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়ের ম্যাচে দুই প্রোটিয়া টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানকে তুলে নেন তিনি।

বাংলাদেশের এই জয়গুলো শুধুমাত্র সাক্ষী হিসেবেই থাকে। বারবার নিয়মিতভাবে হারের কারণে ভক্তদের ক্রোধান্বিত করে তোলেন তারা। তাদের সাধ্য অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পুরোপুরি উত্থানের জন্য অনেক দূরে ছিল তারা। দুর্বল ফিটনেস, দুর্নীতি, পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে দুর্বলতা- সবকিছুই কোণঠাসা করে ফেলেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটকে।

এসবের মাঝেও সাকিব শ্রেষ্ঠত্বের আশার বাতি জালিয়ে গেছেন। ২০১২ এশিয়া কাপে টুর্নামেন্ট সেরা হওয়া, ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১১৪ রান করে সেমিফাইনালে পৌঁছানো এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ৮৪ রান ও ১০ উইকেট নেয়া ছাড়াও বাংলাদেশের অন্য সব ঐতিহাসিক জয়ে সাকিবই মূল ভূমিকা পালন করেছেন।

তার এই দূরন্ত আত্মবিশ্বাসের কারণেই বাংলাদেশে দল এখন সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। তবে সাকিবের জ্বলে ওঠাটা সবসময় শৃঙ্খলা অনুযায়ী হয়নি। ২০১৪ সালে কোচের কথায় রাজী না হওয়ায় তাকে বোর্ড থেকে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধও করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর সাকিব আরো পরিপক্ক হয়ে এসেছে, খবরের পাতা থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন এবং ক্রিকেট নিয়ে কথা বলা পরিবার, বন্ধুদেরও পরিহার করেছেন তিনি। বর্তমানে সাকিব আবারো ফিরে পেয়েছেন টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়কত্ব।

দুর্বল দলের সেরা খেলোয়াড়ের ওপর চাপের বোঝাটা সবসময় বেশি থাকে। তাদেরকে বাধ্য করা হয় সবচেয়ে কঠিন কাজ করার জন্য। নিজের মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস এবং লড়াই করার মানসিকতা নিয়ে সাকিব এই কাজ খুব সহজেই করে আসছে। মিডল ওভারে বোলিং করার চেয়ে এখন তিনি নিয়মিতই পাওয়ার প্লে এবং স্লগ ওভারে বল করে থাকে। শেষ বছরে ওয়ানডেতে সাকিব তিনে ব্যাটিং করা শুরু করে। তিনে ব্যাট করা ১৯ ম্যাচে তার ব্যাটিং গড় ৫৯.৬৮। এর মধ্যে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি রয়েছে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩২২ রান তাড়া করে জয়ের পর সাকিবের উদযাপনটা তার আগের ইনিংসগুলোকে ছাপিয়ে গেছে। এতে বোঝা যায়, দেশের ক্রিকেটের প্রতি তার অবদান কতটুকু। একদম পরিপূর্ণ আচরণেই সতীর্থের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জয়ের মুহূর্তটি স্মরণীয় করে রেখেছে সে। সাকিব সব দেশেই পারফর্ম করার আশা করেন এবং এখন তার দলও করেছে।

এসএইচ-৩২/২০/১৯ (স্পোর্টস ডেস্ক)