আমরা বাঙালি, আমাদের দেশ বাংলাদেশ

বার্মিহামে পা রেখেই পাকিস্তানি ট্যাক্সিচালক সাঈদের কটুক্তি আর নেতিবাচক কথায় মেজাজ গেল বিগড়ে। বাংলায় কথা বলতে দেখেই তার মনে হলো আমরা বাঙালি, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বলা নেই, কওয়া নেই, সৌজন্যতা, ভদ্রতা, নম্রতার লেশমাত্র নেই।

হুট করে বলে বসলেন, ‘আচ্ছা, তোমরা তো পাকিস্তানি, আই মিন ইষ্ট পাকিস্তান, তাই না?’ রেগে উত্তর দিলাম, ‘হোয়াট? কী বলতে চাও তুমি? আমাদের দেশ পাকিস্তান হতে যাবে কেন? আমরা বাঙালি, আমাদের দেশ বাংলাদেশ।’ প্রতিউত্তরে বললো, ‘ওহ! সরি সরি। ভুল বোঝো না যেন, আমি মাজাক (রসিকতা) করেছি।’

এবার তাকে বলে দেয়া হলো, ‘আমরা ৪৮ বছর আগে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ৩০ লাখ বাঙালির তাজা রক্তে স্বাধীন হয়েছি। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। পূর্ব পাকিস্তান নয়। তোমার দেশ পাকিস্তানের চেয়ে আমরা অনেক অনেক ভাল।’

অবস্থা বেগতিক দেখে ঐ পাকিস্তানি ড্রাইভার অবশ্য সুর পাল্টে ফেললো। তারপর অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। কিন্তু জানিয়ে গেল তার জাত-পাত, চরিত্র। বুঝিয়ে দিল পাকিস্তানিরা আসলেই অভদ্র। এখনও বাঙালিকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় থাকে। সুযোগ পেলেই নানান টিপ্পনি কাটে। অবশ্য এতে তাদের জাতিসত্তার পরিচয়টাই মেলে শুধু। বার্মিংহামের ঐ পাকিস্তানি ট্যাক্সি ড্রাইভারের আচরণ আর কথাবার্তায় আবার নতুন করে প্রমাণ হলো জাতিগতভাবে পাকিস্তানিরা বাঙালি বিদ্বেষী, বাঙালির জাতিসত্তার প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধাবোধ নেই তাদের।

কি জানি হয়ত ভাবছেন, কোথাকার এক পাকিস্তানি ড্রাইভার কি বললো না বললো, তা নিয়ে আবার প্রতিবেদন। না না, বিষয়টি মোটেও অমন নয়। ঐ ট্যাক্সি ড্রাইভারের বিচ্ছিন্ন আর বলগাহীন, শিষ্টাচার বহির্ভূত কথাবার্তাই এ লিখার মুল প্রতিপাদ্য নয়, প্রসঙ্গ ভিন্ন।

আসল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, আগামী ২ জুলাই বিরাট কোহলি, রোহিত, ধোনি, পান্ডিয়া , বুমরা, চাহালদের ভারতের সঙ্গে মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক, সৌম্য, লিটন, মোসাদ্দেক, মিরাজ, মোস্তাফিজ ও সাইফউদ্দিনদের কঠিন পরীক্ষা।

রবিন লিগের ম্যাচ হলেও পরিবেশ-প্রেক্ষাপটের বিচারে ঐ ম্যাচ প্রায় নক আউট বা ‘সাডেন ডেথ ‘ হয়ে গেছে টাইগারদের জন্য। সেমিফাইনালের দৌড়ে টিকে থাকতে হলে প্রথমে ২ জুলাই ভারত আর ৫ জুলাই লর্ডসে পাকিস্তানের সাথে জয় খুব জরুরী মাশরাফি বাহিনীর।

এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে টিম বাংলাদেশের পাশাপাশি ঐ ম্যাচে বাংলাদেশ ভক্ত ও সমর্থকদের জন্যও থাকছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সম্ভবত এবারের বিশ্বকাপে আগামী ২ জুলাই এ শহর তথা ইংল্যান্ডের অন্যতম অভিজাত ক্রিকেট ভেন্যু এজবাস্টনে প্রথমবারের মত বাংলাদেশি সাপোর্টারদেরও দিতে হবে কঠিন পরীক্ষা।

ধারণা করা হচ্ছে এই মাঠে ভারতীয় সমর্থক থাকবে বেশি। এটুকু শুনে আবার ভাববেন না, বার্মিংহামে বুঝি প্রবাসী বাঙালি কম। বাংলাদেশিদের সমাগম তাই কম ঘটবে। বিষয়টি আসলে মোটেও তেমন নয়।

লন্ডন, কার্ডিফ, ব্রিষ্টল, টনটন, নটিংহ্যাম, সাউদাম্পটনের মত বার্মিংহামের এজবাস্টনেও বাংলাদেশিদের ঢল নামবে। তবে সেদিন হয়তো বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবেন না। কারণ আগামী ২ জুলাই টাইগারদের ম্যাচ ভারতের বিপক্ষে। আর বার্মিংহামে প্রচুর ভারতীয়।

আজ এক আফগান ট্যাক্সিচালক আবদুল্লাহ পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, এই শহরে ভারতীয় আর পকিস্তানি অনেক বেশি। প্রায় সমান সমান। তবে ভারতীয়রা হয়ত সংখ্যায় কিছু বেশি হবে।

আর আমার কান্ট্রিমেন অর্থাৎ বাংলাদেশিরা? সে জানায়, তোমাদের দেশের লোকও কম না, আছে বেশ। আমি সংখ্যা বলতে পারবো না ঠিকমত। তবে বাংলাদেশের অনেক মানুষ আছে বার্মিংহামে।

শতকরা হিসেবে তারা কত হতে পারে? লিখাপড়া করতে এসে ট্যাক্সিচালনাকে পেশা হিসেবে নেয়া আফগান আব্দুল্লাহর বিনয়ী জবাব, ‘নাহ ভাই ঠিক অত গুছিয়ে বলতো পারবো না। তবে এটুকু বলি শোন, বার্মিংহামে তোমরা বাঙালিরা ভারতীয় ও পাকিস্তানের চেয়ে সংখ্যায় বেশ কম। তাই ধরেই নিতো পার, ভারতের সঙ্গে মাচে তোমাদের চেয়ে ভারতীয়রা সংখ্যায় বেশি থাকবে।’

তা হোক ক্ষতি নেই। সংখ্যা দিয়ে সব কিছু হয় না। ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচে কার্ডিফে ইংলিশরা ছিল মেজরিটি। তারপরও বাঙালির সরব উপস্থিতি টের পাওয়া গেছে। হয়তো বার্মিংহামের এজবাষ্টনেও তেমনি করে বাংলাদেশিদের উপস্থিতি টের পাওয়া যাবে।

এবারের বিশ্বকাপে প্রবাসী বাঙালিরা যেন টিম বাংলাদেশের প্রাণ। লন্ডনের ওভাল, কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন, ব্রিষ্টলের কাউন্টি গ্রাউন্ড, টনটনের সমারসেট কাউন্টি ক্লাব মাঠ, নটিংহ্যামের ট্রেন্টব্রিজ, সাউদাম্পটনের হ্যাম্পশায়ার বোলে (রোজ বোল) বাংলাদেশের ম্যাচে বাংলাদেশির ঢল নেমেছে।

প্রতি ভেন্যুতে গড়পড়তা তিন-চার হাজার কিংবা কোন কোন স্টেডিয়ামের পাঁচ হাজারেরও বেশি প্রবাসী বাঙালি প্রিয় জাতীয় দলকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে লাল সবুজ পতাকা আর জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলা দেখতে এসেছিলেন। একমাত্র কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি ছাড়া সব স্টেডিয়ামেই প্রবাসী বাঙালি তথা বাংলাদেশিরা ছিলেন সংখ্যায় বেশি।

দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া আর আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলায় স্টেডিয়ামে বাঙালিই চোখে পড়েছে অনেক বেশি। ‘বাংলাদেশ-বাংলাদেশ’ জয়োধ্বনিতে কেঁপে কেঁপে উঠেছে বিভিন্ন স্টেডিয়াম ও তার চারপাশ।।

নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী নির্বিশেষে বেশিরভাগের পরনে থাকছে বাংলাদেশের সবুজ জার্সি। গ্যালারি ও বিভিন্ন স্ট্যান্ড প্রায় সবুজাভ হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন দলের ক্রিকেটাররাও বাংলাদেশের এমন বিপুল সমর্থন দেখে বিস্মিত। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও প্রতিটি ভেন্যুতে নিজ দেশের মানুষের এমন বিশাল সমাগম আর বাঙালিদের স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন এবং উৎসাহ-উদ্দীপনায় মুগ্ধ।

মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক, তামিমরা বারবার প্রবাসী বাঙালিদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন, কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন। আর বলেছেন, ‘জানতাম, যুক্তরাজ্যে আমাদের অনেক স্বদেশি ভাইবোন থাকেন। তারা খেলা দেখতে মাঠে আসবেন। আমাদের সমর্থন জোগাবেন। কিন্তু তাই বলে মাঠে এত বাঙালির দেখা পাব, ভাবিনি কখনও। আর তাদের অকুণ্ঠ সমর্থনও অতুলনীয়।’

এদিকে লন্ডন, ব্রিষ্টল, টনটন আর বার্মিংহামের প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে আগামী ২ জুলাই ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ দেখতে গোটা যুক্তরাজ্য থেকে হাজার হাজার প্রবাসী বাঙালি এবং দেশ থেকে আসা কয়েকশ টাইগার সমর্থক প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ঐ ম্যাচের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। অনলাইনে শ’তিনেকের কম (২৮১টি) টিকিট বিক্রি বাকি আছে। আজ স্থানীয় সময় বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অনলাইন টিকিট ক্রয়-বিক্রয়ের চালচিত্র ছিল এমন।

এসএইচ-১২/২৮/১৯ (স্পোর্টস ডেস্ক)