কোন ভুলে বাংলাদেশের সেমিতে খেলা হলো না

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য ২০১৫ অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে। সেবার ইংল্যান্ডের মত দলকে পেছনে ফেলে শেষ আটে খেলেছিল বাংলাদেশ। ২০০৭ বিশ্বকাপেও শেষ আটে খেলেছিল টাইগাররা। তবে সেবার ছিল সুপার এইট। ২০১৫ সালে ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল।

এবার বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল সেমিফাইনাল। ১৯৯২ সালের ফরম্যাট ফিরিয়ে আনার কারণে যদিও সেমিতে খেলার লক্ষ্যটা ছিল খুব বড়। কারণ, গ্রুপ পর্বেই খেলতে হবে ৯টি ম্যাচ। এত লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে সত্যি সত্যি সেমিতে খেলা যাবে কি না তা নিয়ে ছিল যথেষ্ট সন্দেহ-সংশয়।

তবে, সেমিতে খেলার জন্য যে পরিকল্পনা ছিল, তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল প্রথম থেকেই। লন্ডনের দ্য ওভালে প্রথম ম্যাচেই ৩৩০ রানের বিশাল স্কোর গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মত শক্তিশালী দলকে হারিয়ে দিয়েছিল ২১ রানের ব্যবধানে। সূচনাটা এমন উড়ন্ত হবে, ভাততে পারেনি কেউ। তবে টাইগারদের এমন সূচনায় নড়ে-চড়ে বসে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। সেমিফাইনালে খেলা স্বপ্নটা আরও বড় হতে থাকে তখন থেকে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনাল খেলতে পারছে না বাংলাদেশ। ৬ষ্ঠ দল হিসেবে টুর্নামেন্ট থেকে বাংলাদেশের বিদায় নিশ্চিত হয়েছে ভারতের কাছে ২৮ রানে হারের পর। ৫ম দল হিসেবে সেমির আগে বিদায় নিশ্চিত হচ্ছে পাকিস্তানের। যার আনুষ্ঠানিকতা হয়ে যাবে আগামীকাল। সেমিফাইনাল খেলবে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ড।

কেন দারুণ সম্ভাবনা জাগিয়েও সেমিফাইনাল খেলতে পারলো না বাংলাদেশ? কেন হতাশা সঙ্গী করে ফিরে যেতে হচ্ছে? বাংলাদেশ দলের প্রাণভোমরা সাকিব আল হাসান জানিয়ে দিয়েছেন, দলের ক্রিকেটারদের আরেকটু মরিয়া হয়ে চেষ্টা করা উচিৎ ছিল।

ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে তিনি এক টিভির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা যথেষ্ট ভালো খেলেছি বটে; কিন্তু কেবল যথেষ্ট ভালোই আমরা খেলতে চাইনি। আমরা চেয়েছি জিততে। সেটা সম্ভব হয়নি। এত বড় টুর্নামেন্টে যে আশা নিয়ে আমরা এসেছিলাম তা পূরণ করতে পারলাম না, সেদিক থেকে হতাশাজনক। যদি ছোট ছোট কিছু জিনিস ঠিক করতে পারতাম, তাহলে হয়ত ফল ভিন্ন হত।’

সাকিবের ভাষায় সেই ছোট ছোট বিষয়গুলোই এখন অনেক বড় হয়ে গেছে বাংলাদেশের জন্য। ছোট ছোট ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে অন্তত কয়েকটি নিশ্চিত জয়ের ম্যাচে। সেই ভুলগুলো না হলে ম্যাচের ফল ভিন্নও হতে পারতো।

তবে, বাংলাদেশের সেমিফাইনালে খেলতে না পারার পেছনে ছোট ছোট নয়, তিনটি বড় ভুলই সবচেয়ে বেশি দায়ী। ওই তিনটি বড় ভুল যদি না হতো, তাহলে হয়তো বা আজ পয়েন্টে টেবিলের অবস্থা হতো অন্যরকম। এমনকি হয়তো বা বাংলাদেশ তৃতীয় কিংবা দ্বিতীয় সেরা দল হিসেবেই সেমিফাইনালে নাম লিখে ফেলতে পারতো।

কি সেই তিন ভুল, যে গুলোর কারণে সেমিফাইনালে খেলা সম্ভব হলো না বাংলাদেশের? আসুন জেনে নেয়া যাক।

১. নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মুশফিকের ‘বাচ্চাসূলভ’ রানআউট মিস

নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ একেবারে শেষ মুহূর্তে নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে গিয়েছিল মাত্র ২ উইকেটের ব্যবধানে। ২৪৪ রান করেও দারুণ লড়াই করেছিল টাইগাররা।

কিন্তু ওই ম্যাচে ২৪৪ রান নিয়েও জিততে পারতো বাংলাদেশ। যদি না ইনিংসের দ্বাদশ ওভারে ৮ রানে থাকা কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসকে ‘বাচ্চাসূলভ’ ভুল করে মুশফিকুর রহীম রানআউটটা মিস কর না করতেন!

দ্বাদশ ওভারের দ্বিতীয় বলের ঘটনা। সদ্যই উইকেটে আসা রস টেলরের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বিপদে পড়েন অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। মিড অফ থেকে তামিম ইকবালের থ্রো ধরে উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহীম যখন উইকেট ভেঙে দেন, তখনো পপিং ক্রিজের অনেক বাইরে উইলিয়ামসন।

কিন্তু উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহীম করে বসেন এক অমার্জনীয় ভুল। তামিমের করা থ্রোটি সরাসরি ছিলো উইকেট বরাবরই। কিন্তু বাড়তি সতর্কতা নিতে গিয়ে স্ট্যাম্পের সামনে এসে বল ধরে উইকেট ভাঙতে যান মুশফিক। ঠিক তখন তার হাতে লেগে আগেই পড়ে যায় বেলস। যে কারণে আর আউট হলেন না উইলিয়ামসন। শেষ পর্যন্ত তিনি করেন ৪০ রান।

২. ডেভিড ওয়ার্নারের ক্যাচ মিস সাব্বিরের

অস্ট্রেলিয়ার কাছে বাংলাদেশে হেরেছিল ৪৮ রানের ব্যবধানে। অসিদের করা ৩৮১ রানের বিশাল ইনিংসের জবাবে বাংলাদেশ করেছিল রেকর্ড ৩৩৩ রান। রেকর্ড গড়েও জিততে না পারার আক্ষেপ বাংলাদেশ সমর্থকদের মনে। কিন্তু সেই ম্যাচে জিততেও পারতো বাংলাদেশ। একটা বড় ভুলের কারণেই ম্যাচটাতে এত ভালো খেলেও জেতা হলো না।

ওই ম্যাচে ডেভিড ওয়ার্নার ১০ রানের মাথায় যে জীবন পেয়েছিলেন সাব্বির রহমানের কল্যানে, সেই জীবন দিয়ে বাংলাদেশকেই হারিয়ে দিলেন তিনি।

ইনিংসের পঞ্চম ওভারেই মাশরাফি বিন মর্তুজার বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। সেখানে ফিল্ডার ছিলেন সাব্বির রহমান। কিন্তু সেই ক্যাচটি তিনি তালুবন্দী করতে পারেননি। এই এক ভুলেই ব্যক্তিগত ১০ রানের মাথায় জীবন পেয়ে যান অসি ওপেনার ওয়ার্নার।

সেই জীবন কাজে লাগিয়েই দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি তুলে নেন তিনি। শুধু সেঞ্চুরি করেই ক্ষান্ত হননি। নিজের ইনিংসকে নিয়ে গেছেন ১৬৬ রানে। অর্থ্যাৎ, সাব্বিরের এক ভুলে ১৫৬ রান বোনাস পেয়েছেন ওয়ার্নার এবং অস্ট্রেলিয়া। যদি এই অসি ওপেনার ১০ রানেই আউট হতেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত জিততেও পারতো বাংলাদেশ।

৩. ১০ রানে রোহিত শর্মাকে জীবন দিলেন তামিম ইকবাল

ভারতের বিপক্ষে ডু-অর-ডাই ম্যাচ এজবাস্টনে। জিতলে টিকে থাকবে সেমির স্বপ্ন। হারলেই বিদায়। এমন সমীকরণের ম্যাচে টস জিতে ব্যাট করতে নামা ভারতকে শুরুতেই চেপে ধরতে পারতো বাংলাদেশ।

ভারতীয় ইনিংসের পঞ্চম ওভারেই ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন রোহিত শর্মা। ওই সময় তিনি ছিলেন ১০ রানে। মোস্তাফিজুর রহমানের শর্ট ডেলিভারিটি স্কয়ার লেগের দিকে উড়িয়ে মেরেছিলেন রোহিত। সেখানে ফিল্ডার ছিলেন তামিম ইকবাল। দৌড়ে গিয়ে সেটি একদম হাতেও পেয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে হাত ফসকে পড়ে যায় ক্যাচটি।

১০ রানের মাথায় জীবন পেয়ে গেলেন রোহিত। তার মতো ভয়ংকর একজন ব্যাটসম্যানকে জীবন দেয়া বাংলাদেশ দলকে কতটা ভোগালো, সেটা ম্যাচের মাঝপথেই টের পেয়ে যায় টাইগাররা। ১০৪ রান করে আউট হন রোহিত। ৯৪ রান পেলেন তিনি বোনাস। আর বাংলাদেশ হারলো মাত্র ২৮ রানে। বোঝাই যাচ্ছে, কত বড় ভুলটা করেছিলেন তামিম ইকবাল। নিশ্চিত ক্যাচ নয়, ম্যাচটাই তিনি ফেলে দিয়েছিলেন ওই সময়।

এই তিনটি বড় ভুলের কারণে তিনটি ম্যাচ জেতা হলো না বাংলাদেশের। যদি বড় এই তিন ভুলের সঙ্গে ছোট ছোট ভুলগুলো না করতো টাইগাররা, তাহলে নিশ্চিত ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ডের আগেই সেমিফাইনালে নাম লেখাতো বাংলাদেশ।

ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ অনেক ভালো করছে। ভবিষ্যতেও ভালো করবে। কিন্তু ছোট ছোট এসব ভুলের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে বড় দু’একটি ভুল থেকে যতদিন বের হতে না পারবে বাংলাদেশ, ততদিন সত্যিকার বড় দল হয়ে উঠতে পারবে না। উন্নতিটাও খুব বেশি চোখে পড়বে না।

এসএইচ-১৭/০৪/১৯ (স্পোর্টস ডেস্ক)