বিশ্বকাপের উত্তেজনা শেষ দিচ্ছে টস!

বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেটপ্রেমী! কিন্তু কতটা ক্রিকেট ভালবাসে? যে দেশের প্রধানমন্ত্রীও খেলা দেখা মিস করেন না সে দেশের জনগণ কতটা আবেগী ক্রিকেটের ব্যাপারে? খুলে না বললেও আন্দাজ করা কঠিন নয়। যারা ক্রিকেট খেলেছেন ছোট বেলায় কিংবা এখনো খেলছেন তারা জানেন ক্রিকেট খেলায় টসের গুরুত্ব। আমরা যখন গলিতে ক্রিকেট খেলতাম তখন টস মানে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত। টস জিতলেই ব্যাটিং। আর এবারের বিশ্বকাপে ঠিক সেই গলির ক্রিকেটকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। কোনো দল টসে জিতে ফিল্ডিং নিতে মনে হয় ভুলেই গেছে।

এখন তো ক্রিকেটে কত কী! রণ-কৌশল সাজানোর জন্য কত প্রযুক্তি কত সফটওয়্যার। তবে বিশ্বকাপ এখন এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে, অধিনায়ক টসে নামার আগে কোচরা শুধু একটা নির্দেশই হয়তো বাতলে দিচ্ছেন—‘যাও, টসটা জিতে এসো। আর হ্যাঁ, কী নিতে হবে জানো তো, টস জিতলে?’ কী আবার, ব্যাটিং! টসে জিতুন, ব্যাটিং নিন, ম্যাচ জয় নিশ্চিত!

৫ জুলাই বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ ছিল আগে ব্যাট করা দলের জয় পাওয়ার টানা সপ্তম ঘটনা। বিস্ময়কর হলো, এ বিশ্বকাপে এটাই প্রথম হলো না। এর আগেও টানা সাত ম্যাচে জয় পেয়েছিল প্রথমে ব্যাট করা দল। ২০ জুন থেকে ২৫ জুনে পরে ব্যাট করা দলগুলো জয়ের কোনো সুযোগই পায়নি। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের শেষ ২০ ম্যাচে ১৬টি দল আগে ব্যাট করে জয় পেয়েছে। এ সময়ে স্রোতের বিপরীতে যেতে পেরেছে মাত্র তিনটি দল। নিউজিল্যান্ড ও আফগানিস্তানকে পাকিস্তান হারিয়েছে পরে ব্যাটিং করে। আর শ্রীলঙ্কা আগে ব্যাটিং করেও হেরেছে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে।

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে চারটি ম্যাচ বৃষ্টির উদরপূর্তিতে লেগেছে। বাকি ৪১টি ম্যাচকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ২১ ম্যাচে পরে ব্যাট করা দল ১০ জয় পেয়েছে। ১০-১১—হারটা সমান-সমান বলা যায়। কিন্তু পরের ২০ ম্যাচে সেটা নেমে এসেছে মাত্র ৪টিতে। ১৬-৪, এই হলো অনুপাত!

বিশ্বকাপের প্রথম তিন সপ্তাহে আবহাওয়া একটু ঠান্ডা ছিল, উইকেটও তাজা ছিল এ সময়েই পরে ব্যাট করা দলগুলোর ম্যাচে ফেরার সুযোগ ছিল বেশি। কিন্তু ধীরে ধীরে উষ্ণতা বেড়েছে, উইকেটও ব্যবহৃত হয়ে পুরোনো হয়ে গেছে। এর ফলেই প্রথমে ব্যাট করা দলগুলোর অমন জয়রথ। বিশ্বকাপের ইতিহাসেই পরে ব্যাট করা দলের টানা ছয় ম্যাচের বেশি হারের রেকর্ড আছে মাত্র একটি। সেই কবে ১৯৮৩ বিশ্বকাপে প্রথম সাত ম্যাচে আগে ব্যাট করে জয় পেয়েছিল দলগুলো, সেবারও বিশ্বকাপও হয়েছিল ইংল্যান্ডে।

অথচ গত চার বছরে ইংল্যান্ডের ওয়ানডে ম্যাচগুলো এমন কিছুর আভাস দেয়নি। উইকেটগুলো একেবারে ফ্ল্যাট ছিল, ব্যাট করার জন্য ছিল দুর্দান্ত। এবং সেটা পুরো ১০০ ওভারেই একই রকম থাকত। ফলে তাড়া করতে নামা দলগুলোই বেশি সুবিধা পেত (লক্ষ্য জেনে নামার)। গত বিশ্বকাপের পর থেকে এ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত পরে ব্যাট করে ৩২ ম্যাচে জয় পেয়েছে দলগুলো। আর আগে ব্যাট করে জয়ের দেখা মিলেছে মাত্র ২০ বার।

২০১৯ বিশ্বকাপেই প্রথমে ব্যাট করা দলগুলোকে এমন সুবিধা দিচ্ছে, যা খেলার মূল আনন্দের যে উৎস—ফল নিয়ে অনিশ্চয়তা, সেটাকেই নষ্ট করে ফেলছে। ২৭ জয়ের বিপরীতে মাত্র ১৪ হার। শুধু ১৯৮৭ সালেই এর চেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি ছিল (১৯-৮)। গত তিন বিশ্বকাপে আগে ব্যাটিং বা পরে ব্যাটিং আলাদা করে প্রভাব ফেলেনি। ২০০৭ বিশ্বকাপে ছিল সমানে সমান (২৫-২৫)। ২০১১ বিশ্বকাপে ব্যাটিং এগিয়েছিল (২৪-২৩)। গত বিশ্বকাপে আবারও সমতা এসেছিল (২৪-২৪)।

বিশ্বকাপের শুরুতে আবহাওয়া দেখে প্রথমে ব্যাট করতে চায়নি অনেক দল। প্রথম ২১ ম্যাচে মাত্র চারবার ব্যাট করতে চেয়েছে দলগুলো। তাতে ২ জয় ও ২ হার। ওদিকে পরের ২০ ম্যাচে টসে জিতে ১৫বার ব্যাটিং বেছে নিয়েছে দলগুলো, তাতে ১২টি জয়! ৮০ ভাগ সাফল্য।

বিশ্বকাপের দুই সেমিফাইনাল ও ফাইনাল হবে ওল্ড ট্রাফোর্ড, এজবাস্টন ও লর্ডসে। সবখানেই প্রথমে ব্যাট করা দলগুলো এ বিশ্বকাপে শাসন করেছে। ওল্ড ট্রাফোর্ডে (ভারত-নিউজিল্যান্ড) প্রথমে ব্যাট করে পাঁচটি দলই জিতেছে। এজবাস্টনে (অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড) দুই হার ও দুই জয়। তবে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ভাগে সেটা দুই জয় ও এক হার। ফাইনালের ভেন্যু লর্ডসে চারবার আগে ব্যাট করে কোনো দল বিশ্বকাপে এখনো হারেনি কেউ।

সেমিফাইনাল ও ফাইনালে অবশ্যই তাজা উইকেট দেওয়া হবে। কিন্তু আবহাওয়া যদি এমন উষ্ণ থাকে, তবে তাড়া করা দলগুলোর জন্য কাজটা ভয়ংকর কঠিন হয়ে উঠবে। ‘টস জেতা মানেই তাই ম্যাচ জেতা’ এমন কিছু দেখা যেতে পারে তাই বিশ্বকাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন ম্যাচেই!

এসএইচ-১৫/০৮/১৯ (স্পোর্টস ডেস্ক)