সন্তানদের খাবার কিনতে মাথার চুল বিক্রি করেছিলেন যে নারী

বাচ্চাদের জন্য খাবার কিনতে প্রেমা সেলভাম যেদিন মাত্র দুই ডলারে তার মাথার চুল বিক্রি করে দেন, সেদিন ছিল তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন।

তিন সন্তানের মা প্রেমা সেলভামের স্বামী এর কিছুদিন আগে আত্মহত্যা করেছেন। তার মাথার ওপর ছিল বিরাট ঋণের বোঝা। সেই সঙ্গে ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে তীব্র হতাশা আর বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন। এই বিষণ্নতা তাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়।

তবে স্বামীর মৃত্যুর পরও প্রেমা আশা ছাড়েননি, হাল ছাড়েননি।

কিন্তু যখন সন্তানদের খাবার জোগাড় করতে গিয়ে মাথার চুল কেটে বিক্রি করতে হলো, তারপর যেন প্রেমার কাছে আর কিছুই রইলো না। পাওনাদারদের ঋণ শোধ করা বা সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবার মতো আর কোন উপায় রইলো না।

তবে এর পর যা ঘটেছিল, তা পুরো ভারত জুড়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে।

দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য তামিলনাডুর এক ইটের ভাটায় কাজ করতেন প্রেমা এবং তার স্বামী। কোন রকমে দিন চলছিল তাদের। কিন্তু প্রেমার স্বামী চেষ্টা করছিলেন কীভাবে তাদের আর্থিক অবস্থা আরেকটু ভালো করা যায়। টাকা ধার করে নিজেরাই একটা ইটের ভাটা দেয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু তার উদ্যোগ সফল হলো না। এরপর হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে গত বছর আত্মহত্যা করেন।

এবার সংসারের পুরো দায়িত্বের সঙ্গে স্বামীর ঋণ পরিশোধের দায়ও এসে পড়লো প্রেমার কাঁধে। নিজের শিশু সন্তানদেরও কাজে নিয়ে যেতে হলো তাকে। এভাবেই চলছিল কিছুদিন।

“যখন কাজে যেতাম, প্রতিদিন দুশো রুপির মতো আয় হতো, আমার পরিবারের খরচ চালানোর জন্য সেটা যথেষ্ট ছিল।”

কিন্তু তারপর প্রেমা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ফলে তার আয় কমে গেল। জ্বরে ভুগে তিনমাস তাকে বাড়িতে পড়ে থাকতে হলো। ততদিনে তার আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ, ঋণ বেড়ে গেছে অনেক।

প্রেমার কোন ধরণের সম্পত্তি ছিল না। ছিল না কোন গয়না বা মূল্যবান কিছু, যেটা বিক্রি করতে পারেন।

”আমার কাছে এমনকি একটা দশ রুপির নোট পর্যন্ত ছিল না। কেবল কয়েকটি প্লাস্টিকের ঘটি-বাটি ছিল।”

তারপর হঠাৎ প্রেমার মনে হলো, তার এমন কিছু আছে যা তিনি বিক্রি করতে পারেন।

“আমার মনে পড়লো একটা দোকান আছে যারা মানুষের মাথার চুল কেনে।”

বিশ্বে চুল রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ভারত শীর্ষে। অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী মন্দিরে গিয়ে তাদের চুল বিসর্জন দেন। এই চুল দিয়ে তৈরি হয় পরচুলা।

প্রেমা একটি দোকানে গিয়ে তার চুল বিক্রি করলেন দেড়শো রুপিতে (দুই ডলার)।

এটি বিরাট কোন অংক নয়, বড় কোন শহরে এক বেলার খাবারও কেনা যাবে না এই টাকা দিয়ে। কিন্তু প্রেমার গ্রামে এটা একেবারে কম নয়।

“আমি আমার তিন সন্তানের জন্য তিন প্যাকেট রান্না করা ভাত কিনেছিলাম।”

কিন্তু এটি ছিল সাময়িক সমাধান। প্রেমা জানতেন, তার সামনে আর কোন বিকল্প আর নেই। তখন তিনি চরম কিছু করার কথা ভাবছিলেন।

নিজের জীবন শেষ করে দেয়ার জন্য একটা দোকানে গিয়ে কিছু একটা কেনার চেষ্টা করছিলেন প্রেমা। কিন্তু দোকানদার তার মানসিক অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছিল, কী করতে চলেছেন তিনি। দোকানদার তার কাছে কিছু বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানালো।

প্রেমা বাড়িতে ফিরে আসলেন। সেখানে ভিন্ন কোন উপায়ে আত্মহত্যার কথা ভাবছিলেন তিনি। কিন্তু এবার তাকে বাঁচালেন তার বোন। কাছেই থাকতেন তিনি, এবং ঠিক ঐ সময়টাতেই সেখানে গিয়ে আটকালেন তাকে।

তবে এরপর অপ্রত্যাশিতভাবেই সাহায্য আসতে শুরু করলো প্রেমার জন্য।

প্রেমার দুর্ভাগ্যের কথা শুনেছিলেন বালা মুরুগান তার এক বন্ধুর কাছ থেকে, যিনি একটি ইটভাটার মালিক। প্রেমার কাহিনি যেন তাকে নিজের পরিবারের খারাপ সময়টার কথা মনে করিয়ে দিল।

বালা মুরুগানের বয়স যখন দশ বছর, তখন তার মা একই অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন। খাবার জোগাড় করতে গিয়ে তাকে পুরোনো বই আর পুরোনো খবরের কাগজ পর্যন্ত সেরদরে বিক্রি করতে হয়েছিল। একদিন হতাশায় দুঃখে সন্তানদের মেরে নিজে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শেষ মূহুর্তে মত বদলান তিনি। পরিবারের লোকজন দ্রুত তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে সেবার প্রাণে বাঁচিয়েছিল।

বালা মুরুগান জীবনে অনেক সংগ্রাম করে এখন দারিদ্র থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তিনি এখন একটি কম্পিউটার গ্রাফিক্স সেন্টারের মালিক।

বালা নিজের জীবনের গল্প শোনালেন প্রেমাকে, তাকে আশার আলো দেখালেন। আরেক বন্ধু প্রভুর সঙ্গে মিলে তাকে খাবার কেনার জন্য অর্থ দিলেন। এরপর বালা প্রেমার দুর্ভাগ্যের কথা লিখলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।

“কয়েকদিনের মধ্যে আমার কাছে ১ লাখ ২০ হাজার রুপি সাহায্য আসলো। আমি যখন প্রেমাকে একথা জানালাম, সে ভীষণ খুশি। তার বেশিরভাগ ঋণ শোধ করার জন্য এটা যথেষ্ট ছিল।”

তবে প্রেমার অনুরোধে তার জন্য অর্থ সাহায্য নেয়া এখন বন্ধ আছে।

“সে বলেছে, বাকী ঋণ সে নিজের উপার্জন দিয়ে শোধ করতে পারবে”, বলছেন বালা মুরুগান।

প্রেমাকে এখনো প্রতি মাসে সাতশো রুপি পরিশোধ করতে হয় তার পাওনাদারদের। অন্যদিকে তামিলনাডুর এই জেলার সরকারি কর্মকর্তারাও প্রেমাকে একটি দুধ বিক্রির ডিলারশিপ স্থাপনে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

প্রেমা ধীরে ধীরে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু তার জীবনের যে মর্মান্তিক কাহিনি, ভারতে সেরকম ঘটনা অনেক। ভারতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরও লাখ লাখ মানুষ নিজের অন্ন জোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, বিশ্বে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যার দিক থেকে ভারত দ্বিতীয় স্থানে। যারা দিনে এক ডলার ৯০ সেন্টের কম উপার্জন করে, তাদের চরম দরিদ্র বলে গণ্য করা হয়।

এসএইচ-০৮/০৪/২০ (সোয়ামীনাথান নটরাজন, বিবিসি)