করোনাভাইরাস কি আজাব নাকি ধৈর্য পরীক্ষা?

করোনাভাইরাস

মানুষের ধৈর্য পরীক্ষার জন্য নানান ভয়-ভীতি ও ক্ষয়-ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে কুরআনে। আবার মানুষের অপরাধ ও অবাধ্যতার কারণেও আল্লাহ তাআলা মানুষকে বিপদাপদে নিমজ্জিত করবেন বলে সতর্ক করেছেন কুরআনে। তাহলে মহামারী করোনা কি মানুষের জন্য পরীক্ষা নাকি অপরাধের শাস্তি? করোনাভাইরাস আমাদের কী শিক্ষা দেয়?

মহান আল্লাহ তাআলা নিরাপরাধ। তিনি সব অপরাধ থেকে মুক্ত এবং পবিত্র। মানুষ যেসব রোগ-শোক ভোগ করে তা মানুষের কর্মের পরিণতি। কেননা কোনো মানুষই এ কথা বলতে পারবে না যে, সে অন্যায় অপরাধের উর্ধ্বে। সে কারণেই আল্লাহ মাঝে মাঝে কিছু কিছু জনপদে ভয়-ভীতির উদ্দেশ্যে কিছু রোগ-শোক দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাকে ইরশাদ করেন-

‘আর অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করবো কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ ও জীবনের ক্ষতির মাধ্যমে এবং ফল-ফসলাদি বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে ধৈর্যশীলদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৫)

আবার অনেক সময় মানুষের অপরাধ প্রবণতা স্রষ্ঠার সঙ্গেই নয় বরং মানুষের প্রতি মানুষের অন্যায়-অপরাধে মাত্রা অধিক হারে বেড়ে যায়। জুলুম অত্যাচারের মাত্রা এতো অধিক পরিমাণে বেড়ে যায় যে, অত্যাচারিত মানুষ নিরবে নিভৃতে চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে থাকে।

অত্যাচারিত মানুষের চোখের পানি ও কষ্ট আল্লাহ সহ্য করতে পারেন না। ফলে আল্লাহ তাআলা জমিনে আজাব-গজব নাজিল করতে থাকেন। যা মহামারী আকার ধারণ করে নতুন নতুন রোগ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আকারে পৃথিবীতে নেমে আসে।

যা প্রতিরোধ করা মানুষের অসাধ্য হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাআলা কুরআনের একাধিক আয়াতে এসব বিপদের ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি ঘোষণা করেছেন। আর তাহলো-

>> ‘আর তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ আসে, তা তোমাদের কর্মেরই প্রতিফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন। তোমরা পৃথিবীতে আত্মগোপন করে আল্লাহকে অক্ষম করতে পার না এবং আল্লাহ ব্যতিত তোমাদের কোনো কার্যনির্বাহী নেই, সাহায্যকারীও নেই। [ (সুরা শুরা : আয়াত ৩০-৩১)

>> মানুষের কৃতকর্মের কারণেই স্থলে ও জলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা (অন্যায় পরিহার করে সঠিক পথে) ফিরে আসে। বলুন, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছে। তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক।’ (সুরা রূম : আয়াত ৪১-৪২)

>> (হে রাসুল! আপনি) বলুন, কে তোমাদেরকে আল্লাহ থেকে রক্ষা করবে যদি তিনি তোমাদের অমঙ্গল ইচ্ছা করেন অথবা তোমাদের প্রতি অনুকম্পার ইচ্ছা করলে কে বঞ্চিত করতে পারে? তারা আল্লাহ ব্যতিত নিজেদের জন্য কোনো অভিভাবক ও সাহায্যারী পাবে না।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ১৭)

মহান আল্লাহ তাআলার এ আয়াতগুলোতে অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত ব্যাক্তিদের সঠিক পথে ফিরে আসতে সমূহ বিপদ ও ক্ষয়-ক্ষতির হুশিয়ারি হিসেবে নাজিল করেছেন।

যারা জুলুম-অত্যাচার ও অন্যায়-অপরাধ থেকে ফিরে আসবে তারা মুক্তি পাবে। আর যারা অপরাধের উপর অটল থাকবে তাদের জন্য এ ক্ষয়-ক্ষতিগুলো মাহমারী আকার ধারণ করবে। আর তখন তা হয়ে যায় বান্দার জন্য আজাব ও গজব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণা অনুযায়ী করোনাভাইরাস একটি বৈশ্বিক মহামারী। এটি মানুষের জন্য ধৈর্যের পরীক্ষা নয়, এটি নিঃসন্দেহে মানুষের অন্যায়-অপরাধের শাস্তিস্বরূপ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক প্রকার আজাব ও গজব। এ থেকে মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায় তার অবাধ্যথাকে থেকে ফিরে থাকা।

বিশ্বনবি ঘোষণা করেছেন, ‘যখন কোনা জাতির মধ্যে অশ্লীলতা-বেহায়াপনা ছড়িয়ে পড়বে তখন তাদের মধ্যে এমন এমন রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে যা ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি।’ (ইবনে মাজাহ)

মুমিন মুসলমানের জন্য এ মহামারী এক মহা সতর্কবার্তা। আর অপরাধীদের জন্য এক মহা গজব ও আজাব। অববাধ্যতা ও অন্যায়-অপরাধের ফলে মহামারী করোনায় পতিত হয়েছে বিশ্বের ১২৪টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের লাখেরও বেশি মানুষ। মারা গেছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজরেরও বেশি মানুষ।

আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে অতীতের অনেক জাতির ইতিহাস তুলে ধরেছেন। যারা নিজেদের ওপর, প্রতিবেশির ওপর কিংবা রাষ্ট্রে অধীনস্তদের ওপর জুলুম করেছে, তারা আল্লাহর গজবে পতিত হয়েছে। কুরআনের এসব ইতিহাস আল্লাহ তাআলা মানুষের শিক্ষা গ্রহণের জন্য তুলে ধরেছেন।

তারপরও মানুষ কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। আর তা ভুলে অন্যায়, অপরাধ ও জুলুম-অত্যাচারে নিয়োজিত হয়ে পড়ে। যে কারণে মানুষের ওপর নেমে আসে করোনা-সিডরসহ ভাইরাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সীমাহীন ক্ষয়-ক্ষতি ও শাস্তি। সে কারণেই আল্লাহ তাআলা হুশিয়ারি ঘোষণা করেছেন-
‘এসব জনপদের অধিবাসীরা কি আল্লাহর শাস্তির ব্যাপারে নিশ্চিন্ত বা নিরাপদ হয়ে গেছে যে, রাতের বেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় তাদের ওপর তার শাস্তি নেমে আসবে না? আর এসব জনপদের অধিবাসীরা কি এ বিষয়েও নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ হয়ে গেছে যে, দুপুর বেলায় খেলাধুলায় মত্ত থাকা অবস্থায় তাদের ওপর তার শাস্তি নেমে আসবে না? (সুরা আরাফ : আয়াত ৯৯-১০০)

করোনাভাইরাস মুমিনের জন্য সতর্কতা আর জালিম অত্যাচারীদের জন্য এক মহা গজব। এ গজব থেকে বাঁচতে ইসলামের দিক-নির্দেশনা মেনে চলাই মানুষের জন্য একান্ত প্রয়োজন।

করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে বাঁচতে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষিত সকাল-সন্ধ্যার আমলের পাশাপাশি হাদিসে বর্ণিত দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা জরুরি। আর তাহলো-

>> বেশি বেশি ইসতেগফার করা

অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে ফিরে থাকতে মহান আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা চাওয়া। অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সব সময় পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন থাকা-

اَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِى لَا اِلَهَ اِلَّا هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّوْم

উচ্চারণ : আসতাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষিত সকাল-সন্ধ্যার আমল করা। প্রিয় নবি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় তিন বার বলবে-

بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

উচ্চারণ : ‘বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইউন ফিল আরদ্বি ওয়ালা ফিসসামায়ি, ওয়া হুয়াসসাম উল আলিম।’

অর্থ : ‘আল্লাহর নামে, যার নামের বরকতে আসমান ও জমিনের কোনো বস্তুই ক্ষতি করতে পারে না, তিনি সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী।’ সকাল হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তির উপর আকস্মিক কোনো বিপদ আসবে না। আর যে ব্যক্তি সকালে তিনবার এ দোয়া পড়বে, সন্ধ্যা পর্যন্ত তার ওপর কোনো বিপদ আসবে না।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)

>> اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَ الْجُنُوْنِ وَ الْجُذَامِ وَمِنْ سَىِّءِ الْاَسْقَامِ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাচি ওয়াল জুনুনি ওয়াল ঝুজামি ওয়া মিন সায়্যিয়িল আসক্বাম।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনার কাছে আমি শ্বেত রোগ থেকে আশ্রয় চাই। মাতাল হয়ে যাওয়া থেকে আশ্রয় চাই। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে আশ্রয় চাই। আর দুরারোগ্য ব্যাধি (যেগুলোর নাম জানা নেই) থেকে আপনার আশ্রয় চাই।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)।

>> اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأَخْلاَقِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ وَ الْاَدْوَاءِ

উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আ’মালি ওয়াল আহওয়ায়ি, ওয়াল আদওয়ায়ি।’ (তিরমিজি)

অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার কাছে খারাপ (নষ্ট-বাজে) চরিত্র, অন্যায় কাজ ও কুপ্রবৃত্তির অনিষ্টতা এবং বাজে অসুস্থতা ও নতুন সৃষ্ট রোগ বালাই থেকে আশ্রয় চাই।’ (তিরমিজি)।

বিশেষ করে এ হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করা-

যে দেশ ও অঞ্চলে মহামারী করোনা ছড়িয়ে পড়েছে সেসব দেশ ও অঞ্চলে না যাওয়া। আবার যারা সেসব অঞ্চল ও দেশে রয়েছে তারাও নিরাপদ অঞ্চলে না যাওয়া। হাদিসে এসেছে-

‘যখন কোনো এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়ে তখন যদি তোমরা সেখানে থাকো তাহলে সেখান থেকে বের হবে না। আর যদি তোমরা বাইরে থাকো তাহলে তোমরা সেই আক্রান্ত এলাকায় যাবে না।’ (বুখারি, মুসলিম)

উল্লেখ্য যে, প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনায় বিশ্বের ১২৪টি দেশ ও অঞ্চল আক্রান্ত হয়েছে। এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৩শ জন আর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৪ হাজার ৬৩৩ জনের প্রাণ হারিয়েছে। শুধুমাত্র চীনের মূল ভূখণ্ডেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৮০ হাজার ৭৯৬ এবং মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ১৬৯ জনের।

চীনের পর রয়েছে ইউরোপের দেশ ইতালি। দেশটিতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজার ৪৬২ জন এবং এতে মৃত্যু হয়েছে ৮২৭ জনের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসকে মহামারী ঘোষণা করেছে।

আল্লাহ তাআলা বিশ্বমানবতাকে মহামারী করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত করুন। যাবতীয় অন্যায়-অপরাধ থেকে নিজেদের বিরত রাখার তাওফিক দান কারুন। আমিন।

আরএম-২৫/১৪/০৩ (ধর্ম ডেস্ক)