আম বাজারজাত শুরু হলেও উৎপাদন কমের শঙ্কা

দেশে চলতি মৌসুমের আমের আনুষ্ঠানিক বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে শুক্রবার থেকে এবং প্রশাসন ও আম চাষিদের মধ্যকার সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের বাজারগুলোতে এসেছে গুটি জাতের আম।

তবে আমের বৃহত্তম উৎপাদন হয় যে নওগাঁ জেলায়, সেখানে গাছ থেকে আম সংগ্রহের জন্য ২৫শে মে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে প্রশাসন।

অন্যদিকে মৌসুমের শুরুতেই বাজারে আসে সাতক্ষীরার আম এবং ৫ই মে থেকেই সেখানকার আম বাজারে পাওয়া যাচেছ যাকে আগাম জাত বলা হয়।

সাধারণত যেসব আম গাছ বীজ বা আঁটি থেকে হয় সেই আম গাছ থেকে পাওয়া আমকেই গুটি জাতের আম বলে।

এসব জাতের সুনির্দিষ্ট কোন নাম নেই। তবে ল্যাংড়া (প্রকৃত ল্যাংড়া জাত নয়), ক্ষীরশাপাতি, বারোমাসি, হিমসাগর, হাড়িভাংগাসহ অসংখ্য স্থানীয় জাত আছে যেগুলো গুটি আম হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশের আম বেশি উৎপাদন হয় এমন জেলাগুলোর প্রশাসন, কৃষি বিভাগ ও চাষিদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে আম বাজারজাত করার যে ক্যালেন্ডার হয় সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী গুটি আম বাজারজাত করার মধ্য দিয়েই আমের মৌসুম শুরু হয়।

রাজশাহীর আমচাষী আনোয়ার হোসেন বলছেন, সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাসে আম পাকে এবং শুরুতে গুটি আমই পাকতে শুরু করে। কিন্তু এবার অত্যধিক গরমে কারণে সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই বিক্রি শুরু হলো।

যদিও বাজারে কিছুদিন আগে থেকেই আম পাওয়া যাচ্ছে যেগুলো অতিরিক্ত লাভের আশায় না পাকতেই গাছ থেকে তোলা হয়েছে বলে চাষিরা বলছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ডঃ মোঃ মেহেদি মাসুদ জানিয়েছেন, সাতক্ষীরাসহ কিছু এলাকায় গোবিন্দভোগ, সুরত বোম্বাই ও গোলাপখানসহ কিছু আগাম জাতের আম তোলা হয়েছে সময়ের আগেই।

“বাজারে এগুলো এসেছে কিন্তু স্বাদ পানসা। অথচ এগুলো এখন তোলা হলেও দুর্দান্ত স্বাদের হতো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

ঢাকার গুলশান থেকে বুধবার আম কিনেছেন সেগুফতা চৌধুরী। তিনি বলছেন, আম দেখতে পাকা হলেও ঠিক আমের মিষ্টি স্বাদ পাননি তিনি।

কৃষি বিভাগের হিসেবে গত বছর আম উৎপাদন হয়েছিলো ২৪ লাখ ৯০ হাজার টন। কিন্তু এবার আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাই নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ লাখ ৬০ হাজার টন।

আর এই যে উৎপাদন কম হবে এর কারণ হলো আমের অফ-ইয়ার। অর্থাৎ কিছু আম আছে যেগুলো এক বছর ভালো হলে পরের বছর কম উৎপাদন হয়। এটাকেই আমের অন-ইয়ার ও অফ-ইয়ার বলা হয়।

ডঃ মেহেদি মাসুদ বলছেন, এ বছর আমের অফ-ইয়ার। কারণ গত বছর ভালো উৎপাদন হয়েছিলো কিছু বিশেষ আমের।

“এবার অফ-ইয়ারে রেগুলার ভ্যারাইটি ল্যাংড়া, গোপালভোগ ও ফজলি কম হবে। এগুলো এক বছর বেশি হয়, আর এক বছর কম হয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাষি আব্দুল খালেকও বলছেন যে এসব আম গতবারের চেয়ে এবার তুলনামূলক কম হবে।

তবে বারোমাসিসহ অন্য জাতগুলো দিয়ে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন তারা।

এছাড়া অন্য যেসব জনপ্রিয় জাত আছে যেমন আম্রপালি, হিমসাগর, হাড়িভাঙ্গা, গৌরমতি, যাদুভোগসহ কিছু আম প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ তেমন না থাকলে ব্যাপক পরিমাণ উৎপাদন হয়।

প্রশাসন ও চাষিদের মধ্যকার আলোচনা অনুযায়ী, আজ শুক্রবার থেকে গুটি আম বাজারে আসবে। এছাড়া ২০শে মে গোপালভোগ, ২৫শে মে লক্ষণভোগ, লখণা ও রাণীপছন্দ বাজারে আসবে।

এছাড়া রাজশাহীর হিমসাগর আম এবং রানিপাসান্দ ও লক্ষণভোগ আম পাকার কথা ২৮শে মে, যা বাজার থেকে ক্রেতারা কিনতে পারবেন ৩০শে মে’র দিকে।

রাজশাহীর ল্যাংড়া পাকার কথা পাঁচই জুন, যা বাজারের আসবে ৭-৯ই জুনের মধ্যে ও আম্রপালি আটই জুন থেকে ১৬ই জুনের মধ্যে পাকার কথা, যা ক্রেতারা ১০ বা ১২ই জুনের দিকে প্রথম পর্যায়ের আম্রপালি আম কিনতে পারবেন।

অন্যদিকে ফজলি ও সুরমা ফজলি ১৬ই জুন বাজারে ও আশ্বিনা আম পহেলা জুলাই থেকে বাজারজাত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন।

এছাড়া ১০ই জুলাই থেকে আশ্বিনা ও বারি আম-৪, ১৫ই জুলাই থেকে গৌরমতি এবং ২০ অগাস্ট থেকে ইলামতি আম নামবে।

দেশে হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলিসহ কিছু প্রজাতি বেশি সুপরিচিত এবং এসব আমের ক্রেতাও বেশি থাকে।

উত্তরার বাসিন্দা তানিয়া আলম বলছেন, পুরো আমের সিজনে তিনি অপেক্ষা করেন ফজলি আমের জন্য।

“এটা আমার ভীষণ প্রিয়। তাই অপেক্ষা করি কখন বাজারে আসবে এই আম,” বলছিলেন তিনি।

কৃষি বিভাগের হিসেবে গত কয়েক বছর ধরেই নওগাঁয় আমের উৎপাদন বাড়ছে এবং এ মৌসুমেও আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের চেয়ে নওগাঁতেই বেশি আম আশা করা হচ্ছে।

এই জেলায় এবার ২৯ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৬৮ হাজার ৪৩৫ মেট্রিক টন আম।

প্রাক্কলিত হিসেবে এ আমের বিক্রয় মূল্য হবে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা।

ডঃ মোঃ মেহেদি মাসুদ বলেন, নওগাঁয় বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ বেশি হয় বলে সেখানেই এখন আম উৎপাদন বেশি হচ্ছে।

কৃষি বিভাগের হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে যেখানে প্রতি একরে ৯/১০ টন আম পাওয়া যায় সেখানে নওগাঁয় একর প্রতি আমের উৎপাদন ১৫/১৬ টন।

মাসুদ বলেন, নওগাঁয় আম গাছের ঘনত্ব বেশি হয় বলে সেখানে অল্প জায়গায় বেশি ফলন হয়।

গড়ে যেখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক একরে ১০০ গাছ থেকে নওগাঁয় সেখানে অন্তত ৪০০ গাছ হয় বলে জানান তিনি।

তবে চাষিরা বলছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত হওয়ায় আম ভালো হলে বাজার বেশি জমজমাট হয়ে ওঠে।

ওদিকে, রাজশাহী ও নওগাঁয় আম সংগ্রহের দিন ঠিক করে দেয়া হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জে সে ধরণের কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

এসএইচ-০২/১৪/২২ (অনলাইন ডেস্ক)