শ্রমিকদের ক্রীতদাস বানিয়ে শোষণ!

দেশের দুই লাখ ৭৫ হাজার ৭১৪ জন তরুণ যুবক মালয়েশিয়ায় গেছে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে। তারাসহ মালয়েশিয়ায় এখন বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক। এদের অনেকেই মানবেতর জীবন-যাপন করছে। বাংলাদেশী শ্রমিকরা বৈধ পথে বিদেশে গেলেও পরে অবৈধ শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। তারা দেশে থাকতেই দালালের ফাঁদে পড়ছে। আবার বিদেশে যাবার পর মালিকরা তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নিচ্ছে। তাদের অনেকেই এখন আধুনিক ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে।

শ্রমিকেরা নায্য মজুরি, পাওনা ছুটি সবকিছু থেকেই বঞ্চিত থাকছে। শ্রমিকরা মালিকের মাধ্যমে পাসপোর্ট হরণের শিকার হচ্ছে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করছে, পুলিশি হয়রানির শিকার হচ্ছে, মজুরি কর্তনের শিকার হচ্ছে।

হায়দার আলী তার এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে মোট ১৪১ জন বাংলাদেশী শ্রমিকের সাক্ষাতকার নিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, প্রায় দুই হাজার ১০০ কিলোমিটার ঘুরে, ১৫টি কম্পানি-ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করে এবং আরো ৩৪টির নথিপত্র ঘেঁটে অন্তত ৭৮ জন শ্রমিকসহ ১৪১ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে প্রথম যে সত্য উদ্ঘাটন করা গেল তা হলো জীবিকার সন্ধানে মালয়েশিয়ায় আসা বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রায় সবাই আজ আধুনিক ক্রীতদাস। মালয়েশিয়ায় এই দাস ব্যবসা চলছে রীতিমতো কোম্পানি খুলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি আর আবরার জানান, এটা তো দাসত্ব; আধুনিক দাসত্ব। আগে ক্রীতদাসকে যেভাবে আটকে রাখা হতো, প্রায় সে রকমই আটকে রাখা হচ্ছে তাদের। দুই হাজার ১০০ কিলোমিটার ঘুরে বোঝা গেছে, এখানে পদে পদে পাতা রয়েছে, শ্রমিক শোষণের বিচিত্র ফাঁদ।

সেলেঙ্গার শহরের টিয়ং টট প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শ্রমিক ডরমিটরিতে গিয়ে দেখা গেল, আনুমানিক ১৬ / ১২ ফুট আকারের একেকটি ঘরে ২০ জন শ্রমিক গাদাগাদি করে বসবাস করছে। এ রকম প্রায় ৪০টি ঘরে ৮০০ শ্রমিকের বসবাস। প্রতিটি ঘরের ২০ জন বাসিন্দার জন্য একটি করে বাথরুম।

শ্রমিকদের একটি গাড়িতে তুলে কয়েদির মতো করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কর্মস্থলে। গাড়িতে পাহারায় আছে তামিল নিরাপত্তারক্ষী। জানা গেল, ডিউটি শেষে ওভাবেই আবার তাদের দিয়ে যাওয়া হয় বাসস্থানে। আর এই কড়া পাহারার উদ্দেশ্য দাসরূপি শ্রমিকরা যাতে পালাতে না পারে। জঙ্গলের ভেতর ডেরা গেড়েছে নানাভাবে অবৈধ হয়ে পড়া একদল শ্রমিক। বাংলাদেশের বেদে পল্লীর মতো জরাজীর্ণ ছাউনি ঘরে তারা রাতের আঁধারে কোনো মতে লুকিয়ে থেকে দিনে কর্মস্থলে চলে যায়। মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন ক্যারাম এশিয়ার সাবেক সমন্বয়কারী হারুন-উর রশিদ।

তারও ভাষ্য, কোম্পানিরূপি দালালদের প্রতারণার কারণে অনেক কারখানায়ই বাংলাদেশি শ্রমিকরা ক্রীতদাসের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। দালাল কোম্পানিগুলো অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেশি বেতনে চুক্তি করে শ্রমিকদের কম বেতন ধরিয়ে দিয়ে বাকিটা আত্মসাৎ করে; আবার সেই কম বেতন থেকেও নানা ছুতায় টাকা কেটে নেয়।

পিএসএল রিসোর্সেসের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, স্যামসাং ইলেকট্রনিকস, পুলম্যান হোটেল, লাফার্জ সিমেন্টসহ বেশ কিছু বহুজাতিক কম্পানি তাদের গ্রাহক। তাদের কোম্পানি প্রোফাইলে বিদেশি জনশক্তি সরবরাহকারী পরিচয় থাকলেও কালের কণ্ঠর মালয়েশীয় সহযোগী সংবাদমাধ্যম মালয়েশিয়াকিনির কাছে পিএসএলের পরিচালক লগেসরন দাবি করেন, তাদের কম্পানি সার্ভিস প্রভাইডার হিসেবে কাজ করে থাকে।

বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে দেয়া জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগানুমতিপত্রে শর্ত জুড়ে দিয়ে বলা হয়েছে, কর্মীদের চাকরির শর্তাবলি মালয়েশিয়ার শ্রম আইনের বিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। মালয়েশিয়ার এমপ্লয়মেন্ট ( রেসট্রিকশন) অ্যাক্ট ১৯৬৮, যেটি ১৯৮৮ সালে সংশোধিত হয়েছে, তাতে বলা আছে, বৈধ এমপ্লয়মেন্ট পারমিট ছাড়া মালয়েশিয়ায় কোনো বিদেশি শ্রমিক কাজ করতে পারবে না। পারমিট ছাড়া নিয়োগও দিতে পারবে না কোনো মালিক। পারমিটে যে কাজের উল্লেখ রয়েছে, তার বাইরে কোনো কাজে ওই শ্রমিককে নিয়োজিত করা যাবে না।

মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন ইয়াসিন মালয়েশিয়াকিনির কাছে বলেছেন, আউটসোর্সিং কোম্পানিগুলো গত বছর থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব ড. রৌনক জাহানও জানান, কোনো কর্মীকে এক কোম্পানিতে চাকরি দিয়ে অন্য কোথাও কাজে দেওয়া জিটুজি প্লাস চুক্তি অনুযায়ী কোনোভাবেই কেউ পারে না।

মালয়েশিয়ায় এভাবে শ্রমিকদের নিয়ে দাস ব্যবসা চালাচ্ছে মূলত দুই ধরনের কম্পানি। পিএসএলের মতো শ্রমিক আমদানির কম্পানি আর শ্রমিক বৈধকরণ-নবায়নের কম্পানি। এ রকম হাজারখানেক কম্পানি আছে মালয়েশিয়ায়। এগুলোর মধ্যে কিছু মালয়েশীয় নাগরিকের মালিকানাধীন, পরিচালনা করে তারাই। কিছুর আবার মালিকানা মালয়েশীয়দের নামে হলেও ব্যবসা চালায় দালাল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশিরা।

মান্নান মিয়া নামের এক শ্রমিক বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে আসছিলাম, তা গিলে খেয়েছে দালালরা। পরিবারের মুখে হাসি ফোটাব কী, নিজের জীবন নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছি। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম রাতে ঘুমাই জঙ্গলে্র গ্লোবাল স্লোভারি ইনডেক্স নামের আন্তর্জাতিক সংগঠন আধুনিক দাসত্ব বলতে নানাভাবে হুমকি দিয়ে, জোর করে, বলপ্রয়োগ বা ছলচাতুরির মাধ্যমে শ্রমিকদের থেকে কাজ আদায় করে নেওয়াকে বুঝিয়েছে। এছাড়া পারিশ্রমিকের স্বল্পতা এবং দুর্বল চিকিত্সাভাতাও এর মধ্যে পড়ে। আধুনিক দাসত্বের ওপর করা গ্লোবাল স্লোভারি ইনডেক্স ২০১৬ জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে মালয়েশিয়ার অবস্থান ৫০তম। তাদের জরিপ বলছে, মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ২৮ হাজারেরও বেশি শ্রমিক ক্রীতদাসের মতো জীবনযাপন করছে।

অ্যান্টি-স্কোরি ইন্টারন্যাশনাল নামের সংগঠনের হিসাবে বর্তমান বিশ্বে এখনো ২ কোটি ৭০ লাখ দাস রয়েছে, এই সংখ্যা ইতিহাসের যেকোনো সময়কার দাসের সংখ্যার চেয়ে বেশি। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসানও বললেন, মালয়েশিয়ায় এই সময়ে এসেও দাস কেনাবেচার মতো শ্রমিক কেনাবেচা চলছে। একটি কোম্পানির নামে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভাড়ায় কিংবা বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। যেকোনো কমীর্র বিদেশে যাওয়ার আগে চুক্তিপত্র থাকার কথা। সেখানে সবকিছুই লেখা থাকে, কত ঘন্টা কাজ করবে, কত বেতন পাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা এই চুক্তির নিয়ম মানছে না ।

এসএইচ-০৫/২৫/১৯ (প্রবাস ডেস্ক)