বাংলাদেশি শিক্ষিকা খুন : বিচারের দাবিতে সোচ্চার ৪ ব্রিটিশ এমপি

বাংলাদেশি শিক্ষক সাবিনা নেসার হত্যার বিষয়ে ক্ষোভ এখন ছড়িয়ে পড়েছে ব্রিটেনের সর্বত্র। এই মেধাবী স্কুলশিক্ষিকার এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডে কান্নার রোল কেবল পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়! এ কান্না ছড়িয়েছে দাবানলের মতো লাখো মানুষের হৃদয়ে। আগামী মাসে ছিল সাবিনা নেসার ২৯তম জন্মদিন। এর আগেই এমন হত্যা কেউ মেনে নিতে পারছেন না। তবে ৯ দিনের মাথায় অপরাধী গ্রেফতার হওয়ায় মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। এখন সবার দাবি বিচারের জন্য, দাবি উঠেছে নারী নিরাপত্তা নিয়ে। ৪ ব্রিটিশ বাংলাদেশি এমপি সরব হয়েছেন সাবিনা নেসার মৃত্যুর ঘটনায়।

সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যায়, সাবিনা নেসার হত্যাকারীর নাম। এরপর আবার ছবি প্রকাশ করা হয়। সেই সঙ্গে তিনি কোন দেশের নাগরিক সেই তথ্যও দেওয়া হয়। এই হত্যাকারী আলবেনিয়ান নাগরিক কচি স্লামাজ। রবিবার ভোররাত ৩টার দিকে তাকে তার ইস্ট বর্নেও বাসা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সেই সঙ্গে তার গাড়ি নিশান মাইক্রোও তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। ২৮ সেপ্টেম্বর তাকে উইলসডেন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে তোলা হলে, তিনি দোভাষীর সহায়তায় জাজের সঙ্গে কথা বলেন এবং নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।

২৬ বছর বয়সী কচি স্লামাজ একজন পিৎজা ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করতেন। ২৮ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে কোর্টে তোলা হয়েছিল কচি স্লামাজকে। যেখানে কচি স্লামাজ নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।
কে এই কচি স্লামাজ?

কচি স্লামাজ তার শৈশব কাটিয়েছেন আলবেনিয়ার এলবাসান শহরে। এ শহরটি আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানা থেকে মাত্র ১ ঘণ্টার ড্রাইভ। হত্যাকারী কচি স্লামাজরা দুই ভাই ও দুই বোন। শৈশবে কচি স্লামাজের মধ্যে এমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা দেখতে পাননি বলে জানিয়েছে তার এক প্রতিবেশী। তারা আট-দশটা সাধারণ পরিবারের বাচ্চাদের মতোই ছিল।

তবে শৈশবেই আলবেনিয়া থেকে পরিবার নিয়ে অন্য দেশে চলে যায় কচি স্লামাজের পরিবার। জানা গেছে, কচি স্লামাজের বাবার নাম বাসকিম। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত বিল্ডার। বর্তমানে তার বয়স ৭৩ বছর। আর মায়ের নাম টিফটা। তিনি একজন কমিউনিস্ট ইরা ফার্মার।

কচি স্লামাজের বাবা-মা বর্তমানে আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় থাকলেও এখনো এলবাসান শহরে তাদের নিজস্ব ফ্ল্যাট রয়েছে। তিনি ব্রিটেনে কতদিন ধরে থাকেন তা জানা যায়নি। তবে তিনি গত জুলাই মাস পর্যন্ত ইস্টবর্নে ডমিনোজ পিৎজা শপে কাজ করতেন। তার সাবেক গার্লফ্রেন্ড পুলিশের কাছে দাবি করেছেন অন্তত দেড় মাস আগে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। ইস্টবর্নের যে বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার পাশের নিউজ এজেন্ট দোকানের মালিক বলেছেন, তিনি কথা কম বলতেন, চুপচাপ টাইপের ছিল।

অন্য আরেক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, কচি প্রায়ই ফ্রাইডে নাইট উপভোগ করার জন্য লন্ডনে ক্লাব বা বারে যেতেন। যেদিন সাবিনাকে হত্যা করা হয় সেদিনও শুক্রবার ছিল। হয়তো এমন কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই লন্ডনে আসেন। ধারণা করা হচ্ছে, পথের মধ্যে রেন্ডম কোনো টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন সাবিনা নেসা। অনেকেই রাস্তায় মেয়েদের একা পেলে নানা ধরনের ডিস্টার্ব করার চেষ্টা করেন। সাবিনা চুপচাপের আড়ালে থাকা একজন ভয়ংকর অসুস্থ মনের অপরাধীর কবলে পড়েছিলেন।

যেভাবে খুন হন সাবিনা

টেলিগ্রাফের করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশের একটি সোর্স আরও একটি সিসিটিভি ফুটেজ পেয়েছে যেটি আসলে প্রকাশ করা হয়নি। সেখানে দেখা যায়, নিজের ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়ার ১ থেকে ২ মিনিটের মধ্যেই হত্যাকারীর সঙ্গে দেখা হয় সাবিনার। এ সময় হত্যাকারী ধাতব একটি বস্তু দিয়ে আঘাত করেন সাবিনাকে। আর এতে সাবিনা অজ্ঞান বা মারা গেলে তাকে কাঁধে করে হত্যাকারী পার্কের মধ্যে নিয়ে ফেলে দেন।

সিসিটিভির ফুটেজে সাবিনাকে মারা থেকে শুরু করে কাঁধে করে পার্কের মধ্যে প্রবেশ পর্যন্ত পুরো ঘটনার রেকর্ড আছে। তারপর সেই একই লোককে সাবিনা নেসা যে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পথে ছিলেন সেই রেস্টুরেন্টের পাশের পেগলার রোডে একটি সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়েন। তখন দেখা যায় তিনি হাতে লাল কিছু লুুকানোর চেষ্টা করছেন। সেই সঙ্গে একটি গাড়ির ছবিও প্রকাশ করে পুলিশ।

পুলিশ এবং ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৭ সেপ্টেম্বর রাত ৮টা ৩০ মিনিটে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে বের হয়ে বাসার পাশের পার্ক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সাবিনা খুন হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর তার লাশ পাওয়া গেলেও ২০ সেপ্টেম্বর তার পরিচয় প্রকাশ করে পুলিশ। এরপর থেকে তদন্ত অব্যাহত রাখে পুলিশ। ২৩ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার পুলিশ ঘোষণা দেয় সাবিনা অপরিচিত লোকের দ্বারা আক্রান্ত ও খুন হন।

সাবিনার করুণ মৃত্যুতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলেছেন ৪ ব্রিটিশ বাংলাদেশি এমপি। বো বেথনালগ্রিন এমপি রুশনারা আলী বলেছেন, কোনো নারীই আসলে নিরাপদ নয়। আমিসহ আমার কলিগ, বন্ধু কাউকেই আমি নিরাপদ দেখি না। নারীরা সবসময় নির্যাতনের জন্য লক্ষ্য হয়ে থাকেন।

কিলবার্ন-হ্যাম্পস্টেড এমপি টিউলিপ সিদ্দিক বলেন, আমি সাবিনার বোনের সঙ্গে কথা বলেছি। এটা খুবই দুঃখজনক। তাদের ক্ষতি আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে পোষানো যাবে না।

ইলিংয়ের সংসদ সদস্য রূপা হক বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। প্রত্যেক নারীর অধিকার আছে রাস্তায় নিরাপদ থাকার। সাবিনার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে এটা নৃশংসতার চূড়ান্ত। এটা আমাদের যে কারোর মেয়ের সঙ্গেই ঘটতে পারে।

পপলার-লাইমহাউসের সংসদ সদস্য আপসানা বেগম বলেন, আমি নিজে শোকসভায় ছিলাম, সাবিনার মৃত্যু আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে।

এসএইচ-২৩/০১/২১ (প্রবাস ডেস্ক)