বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে!

বিধি ভেঙে ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে বা জামাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ পুরোনো৷ সবশেষ বাসার গৃহকর্মী ও গৃহকর্মীর স্বামীকেও নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে৷

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেন ভিসিদের পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এমন অভিযোগ উঠেছে নানামহল থেকে৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা দেশে যে পরিবারতন্ত্র চলছে তারই প্রতিফলন৷ আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) মনে করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগের পদ্ধতি পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক বিবেচনা বাদ দিয়ে প্রকৃত শিক্ষাবিদদের নিয়োগ না দিলে এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে৷

এর আগে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. শহীদুর রহমান খান আলোচনায় আসেন নিজের পরিবারের নয় সদস্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়ে৷ তিনি নিজের ছেলে ও শ্যালককে সেকশন অফিসার, চার ভাতিজাকে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ল্যাব টেকনিশিয়ান ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ দিয়েছেন৷ শ্যালিকার ছেলেকে সহকারী প্রকৌশলী, নিকটাত্মীয় একজনকে ডেটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ দিয়েছেন অস্থায়ী ভিত্তিতে৷ আর মেয়েকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন অবৈধ উপায়ে৷ ইউজিসি তদন্তে এসব অবৈধ নিয়োগের প্রমাণ পেলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷

এর আগে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এম আবদুস সেবহান গত বছর অবসরের ঠিক আগের রাতে ১৩৮ জনকে নিয়োগ দিয়ে তুমুল আলোচনায় আসেন৷ শুধু তাই নয়, এই ভিসি ২০১৮ সালে নিজের মেয়ে এবং জামাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানাতে একটি বিভাগই খুলে ফেলেন৷

এর বাইরেও আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ জনের অবৈধ নিয়োগের খবর৷ সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে৷ গত এক বছরেই ১৭ জন উপার্যের বিরুদ্ধে নানাভাবে অবৈধ নিয়োগের অভিযোগ পেয়েছে ইউজিসি৷

কিন্তু ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের সময় এরকম সাতজন উপাচার্যকে অপসারণ করা হলেও এর পরে আর কোনো উপাচার্যকে শাস্তি বা অপসারনের মুখোমুখি হতে হয়নি৷

ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামান তুহিন বলেন, ‘‘ইউজিসির পক্ষ থেকে এই প্রথমবার আমরা খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছি৷ এটা আইনে পরিবর্তন আনায় আমরা পেরেছি৷ এর বাইরে আমাদের কিছু করার নেই৷ আমরা তদন্ত করতে পারি, সুপারিশ করতে পারি, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনা৷ আমরা অনেক অভিযোগ পাই৷ তদন্ত করি৷ ওই পর্যন্তই৷”

শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ বিধি থাকলেও, নিয়োগ কমিটি থাকলেও তা ভিসিদের রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয়েছে৷ তারা যা বলেন তাই হয়৷ তার সঙ্গে যারা থাকেন তারাও সুবিধা নেন৷ ফলে ভিসিদের পক্ষে অবৈধ নিয়োগ দেয়া আরো সহজ হয়৷”

তার কথা, ‘‘এটা শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রেই এটা হচ্ছে৷ নেতারা তাদের ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনকে ক্ষমতার জোরে পদ, পদবী দিচ্ছেন৷ ভিসিরা পিছিয়ে থাকবেন কেন? দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি এখন সবখানে৷”

তিনি বলেন, ‘‘দেশে ভিসি হওয়ার মত ভালো শিক্ষাবিদ আছেন৷ কিন্তু ‘ব্যাড মানি ডিরাইভস গুড মানি’৷”

আর ফেরদৌস জামান বলেন, ‘‘রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি নিয়োগের কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ নানা তদবির করে এখন ভিসি হন৷ এটা চলতে থাকলে এভাবে ভিসিদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ চলতেই থাকবে৷”

তিনি বলেন, ‘‘প্রকৃত শিক্ষবিদদের নিয়োগ দিতে ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে৷ ইউজিসি শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে পরামর্শ দিতে পারে৷ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়৷”

এদিকে সর্বশেষ অভিযুক্ত দুইজন ভিসির সাথে কথা বলার চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি৷

এসএইচ-০২/২৮/২২ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)