কেন ৪৭ বছরে ভোটই দেননি চাঁদপুরের এই নারীরা?

কেন ৪৭ বছরে

চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নে মোট ভোটার ২৪ হাজার ৪শ’ ৫৪ জন৷ তাঁদের মধ্যে নারী ভোটার ১২ হাজার ১শ’ ১৪ জন৷ নারীরা মোট ভোটারের অর্ধেক হলেও তাঁদের ভোট ছাড়াই জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন৷ এই অর্ধেক ভোটারের ভোট নিয়ে কারো তেমন মাথা ব্যথাও ছিল না৷ না জন প্রতিনিধি, না নির্বাচন কমিশন অথবা প্রশাসনের৷ এ খবর দিয়েছে ডয়চে ভেলে।

নির্বাচন প্রশাসনের দাবি, তারা এতদিন বিষয়টি জানতেনই না৷ এবার লোকমুখে শুনেছেন৷ কিন্তু প্রতি নির্বাচনের আগেই সংবাদমাধমে ভোট না দেয়া এই নারীদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷ এবারও হচ্ছে৷

কেন নারীরা ভোট দেন না?

বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজের চাঁদপুর প্রতিনিধি তালহা জুবায়ের কয়েকদিন আগে রূপসা এলাকার ওই নারীদের নিয়ে প্রতিবেদন করতে যান৷ সেখানে নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, তাঁদের প্রায় কারোই নির্বাচনে ভোট দেয়ার অভিজ্ঞতা নেই৷ জয়পুরী বা জৈনপুরী নামে এক পীরের কথিত নির্দেশে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ওই এলাকার নারীরা ভোট দেন না৷ পীর সাহেব নারীদের ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেন৷ পর্দায় থাকতে বলেন৷ এখন নারীরা নানা কাজে বাইরে গেলেও ভোট না দেয়ার রেওয়াজ অব্যাহত আছে৷

তালহা জানান, ‘‘এই এলাকার নারীরা এখনো মনে করেন, তাঁরা ভোট দিলে বিপদ হতে পারে৷ তাঁদের বিশ্বাস পীরের নির্দেশ অমান্য করলে কোনো ক্ষতি হতে পারে৷ এলাকায় এমন কথাও প্রচলিত আছে যে, দু-একজন নারী অতীতে ভোট দিতে যাওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ কিন্তু তার কোনো প্রমাণ নেই৷ আর এখন সেই পীরও নেই৷ তার কোনো দরগাহ বা আস্তানাও নেই৷ তারপরও তাঁরা ওই কথিত নির্দেশের কথা বিশ্বাস করেন৷”

তালহা আরো জানান, ‘‘নারীরা ভোট না দিলেও নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিন্তু আছেন৷ নারীরা ভোটেও দাঁড়ান৷” তিনি বলেন, ‘‘মনোয়ারা বেগম নামে এক নারী কাউন্সিলরের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে৷ তিনি জানিয়েছেন, নারীরা ভোটে দাঁড়ালেও নারী আত্মীয়-স্বজন ছাড়া আর কোনো নারী ভোট দেন না৷ আমরা পুরুষ ভোটারদের ভেটেই কাউন্সিলর হই৷”

পীরের নির্দেশ, নাকি গুজব?

ফরিদগঞ্জ রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. ইসকান্দার আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওই পীর কোনো নির্দেশ দিয়েছিলেন কিনা তা আমার জানা নেই৷ আসলে আমার মনে হয়, এটা একটা গুজব আর গুজবের ওপর ভিত্তি করেই নারীরা বছরের পর বছর ভোট দিচ্ছেন না৷ এর জন্য আমরাও দায়ী৷ আমরা এতদিন তাঁদের ভোট দেয়ানোর কোনো উদ্যোগ নেইনি৷ আমরা বিভিন্ন সময় যাঁরা চেয়ারম্যান হয়েছি, তাঁরা এটাকে ঝামেলা মনে করেছি৷ মনে করেছি, নারীদের ভোটের উদ্যোগ নিলে না আবার আমার ভোট কমে যায়!”

তিনি বলেন, ‘‘তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে৷ নারীরা অল্প সংখ্যায় হলেও ভোট দিতে শুরু করেছেন৷ এবার নারীরা ব্যাপক সংখ্যায় ভোট দেবেন বলে আশা করি৷ আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালাচ্ছি৷ নানা সভা-সমাবেশ করছি৷ নারীদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস ভাঙছে, পুরুষরাও তাঁদের ভোট দিতে বলছেন৷ এবার সংসদ নির্বাচনে এখানকার প্রার্থীরাও কাজ করছেন৷”

নির্বাচন কমিশনের ঘুম ভাঙবে?

রূপসা এলাকার নারীরা যে স্বাধীনতার পর থেকে ভোট দিচ্ছেন না সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই জেলা নির্বাচন কমিশন অফিসে৷ তারা লোকমুখে এবারই নাকি শুনেছেন৷ আর ওই এলাকা থেকে লিখিত কোনো আবেদন না পাওয়ায় নির্বাচন কমিশনকে এখনো জানানো হয়নি৷ তবে প্রক্রিয়া চলছে বলে দাবি করেছেন চাঁদপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিষয়টি আপনার কাছ থেকে শুনলাম৷ আরো কয়েকজন সাংবাদিক এবং স্থানীয় অধিবাসীরা আমাকে বলেছেন৷ এর আগে আমি জানতাম না যে, রূপসা এলাকায় নারীরা ভোট দেন না৷ আর কেন দেয় না তার কারণও আমার জানা নেই৷ এটা এখানে রেওয়াজ হিসেব চলে আসছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘ওই এালাকায় রিটার্নিং ও পোলিং অফিসাররা কাজ করছেন৷ তাঁরা সরাসরি নির্বাচন কমিশনকে জানাবেন৷ নির্বাচন কমিশন যে পরিকল্পনা দেয় সে অনুযায়ী আমরা নারী ভোটারদের জন্য কাজ করব৷”

তিনি বলেন, ‘‘তবে কিছু এনজিও ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে৷ তারা নারী ভোটারদের মধ্যে প্রচারপত্র, লিফলেট বিলি করবেন৷ পোস্টারও করবেন৷ আয়োজন করবেন মত বিনিময়ের৷ তবে তা এখনো শুরু হয়নি৷”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমরা আশা করি এবারের নির্বাচনে রূপসার নারী ভোটাররা ভোট দিতে যাবেন৷ তবে কেউ না গেলে আমাদের কিছু করার নেই৷ ভোট দেয়া ভোটারের স্বাধীনতা৷ কেউ যদি ভোট দিতে না যান, তাঁকে বাধ্য করা যায় না৷”

তবে তালহা জুবায়ের বলেন, ‘‘নারী ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিতে কিছু উদ্যোগ এবার নেয়া হলেও আমি নারী-পুরুষ উভয়ের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের প্রচলিত ধারণায় বড় কোনো পরিবর্তন দেখিনি৷”

আরএম-১৬/০১/১২ (অনলাইন ডেস্ক)