বাড়িতে বসে থাকতে ভাল না লাগায় করেন ট্রাফিকের কাজ
‘বাড়িতে বসে থাকতে ভাল লাগে না। কাজ ছাড়া থাকতে পারি না। শহরটাকে ভালবাসি। তাই টাকা ছাড়াই ট্রাফিক সামলাই’ ভাঁজ করে পড়া হনুমান টুপিটা মাথা থেকে খুলতে খুলতে বললেন নারায়ণ কুণ্ডু। বয়স ৭০। শীর্ণ চেহারা। মাঝারি উচ্চতা। মুখে কয়েকদিনের না কামানো সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি–গোঁফ। নীল সোয়েটারের ওপর ফ্লুরোসেন্ট জ্যাকেট। এই তাঁর ইউনিফর্ম। ট্রাফিক সামলানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, তাই মোবাইল ব্যবহার করেন না। কথাও বলেন কম।
দেড় বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত রাস্তার ট্রাফিক সামলাচ্ছেন দত্তপুকুরের বাসিন্দা নারায়ণবাবু। রোজ সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সন্ধে ৭টা পর্যন্ত পার্ক সার্কাস ৭ পয়েন্ট ক্রসিং–এর ‘পেডেস্ট্রিয়ান ক্রসওভারের’ দায়িত্বে দেখা যায় এই ‘ট্রাফিকম্যান’কে। মা উড়ালপুল তৈরির সময় কেএমডি–এর ঠিকা ট্রাফিক কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। উড়ালপুল তৈরি হয়ে যাওয়ার পর পর স্বাভাবিক নিয়মেই চাকরির মেয়াদ ফুরোয়।
কিন্তু ততদিনে রাস্তার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক হয়ে গেছে বৃদ্ধের। যে কারণে আবার পরদিনই ফিরে এসে তাঁর নির্ধারিত জায়গায় কাজ শুরু করে দেন। কর্তব্যরত স্থায়ী ট্রাফিক কর্মীরা অবাক হয়েছিলেন। নারায়ণবাবু কাতর গলায় বলেছিলেন, ‘বাড়িতে বসে থাকতে ভাল লাগে না। কাজ ছাড়া বাঁচতে পারব না। পয়সা লাগবে না, কাজ করতে চাই।’
‘তারপর থেকে আর কামাই করিনি’ বললেন নারায়ণবাবু। ‘বাড়িতে স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে আমার সংসার। ছেলে বিএসসি পাশ করে চাকরির চেষ্টার পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসা করছে। ওর সামান্য রোজগারেই সংসার চলে। ও অনেকবার বারণ করেছে, আমি শুনিনি। আমি কাজ ছাড়া থাকতে পারি না।’
ভোর ৬টায় উঠে বাড়ির কাজকর্ম, বাজারহাট সেরে ট্রেনে শিয়ালদা। সেখান থেকে তাঁর কর্মস্থল, পার্ক সার্কাস ক্রসিং। রোজই এক রুটিন। রোজ হাজার হাজার গাড়ির স্র্রোত বয়ে যায় পার্ক সার্কাসের ওই ক্রসিং দিয়ে। অনেকেই মুহূর্তের জন্য বয়স্ক মানুষটার দিকে তাকান। বেশিরভাগ মানুষই হয়তো লক্ষ্যই করেন না। তাতে অবশ্য কিছু আসে–যায় না তাঁর। পারিশ্রমিকের পাশাপাশি কোনও কৃতিত্ব চান না তিনি।
‘ডিউটিতে কোনও ফাঁক নেই নারায়ণবাবুর। কেএমডিএ–র অস্থায়ী ট্রাফিক কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করছেন। তিনি কাজেও ভীষণ দক্ষ। পুলিস মেসে দুপুরের খাবার খান। ডিউটির জন্য জুতো, শীতে সোয়েটার দেওয়া হয়। ওনাকে সবাই খুব ভালবাসে। নারায়ণবাবু তরুণ ট্রাফিক কর্মীদের অনুপ্রেরণা।’ বললেন ইস্ট ট্রাফিক গার্ডের সার্জেন্ট নারায়ণ নাথ।
কাজের ফাঁকে কথা বলছিলেন নারায়ণ কুণ্ডু। বললেন, ‘যতদিন শরীর দেবে, কাজ করব। ছেলেকে সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরির জন্য চেষ্টা করতে বলেছি। ওর একটা হিল্লে হয়ে গেলে…’ কথা শেষ না করেই এক মুহূর্ত সিগন্যালে তাকিয়ে এগিয়ে গেলেন ট্রাফিকম্যান নারায়ণ। স্কুলের বাচ্চারা দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাস্তা পার করাতে হবে। দৃপ্ত ভঙ্গিতে লম্বা পা ফেলছেন তিনি। ৭০ তাঁর কাছে শুধু একটা নম্বর।
এসএইচ-০২/০৮/১৯ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : আজকাল)