হটাৎ করে উধাও কেন উধাও ‘বৌদি’রা?

হটাৎ করে উধাও

রমেশ, নরেশ, পরেশ কে কি চেনেন ১৯৮০-র পরে জন্মানো বঙ্গসন্তানরা? পরিচয় রয়েছে রমা, বেলা, শিলাবৌদির সঙ্গে? একদা এঁরাই যে বঙ্গপুরুষের বয়ঃসন্ধিকে সামলে রেখেছিলেন, সেই ইতিহাস এখনও পর্যন্ত অলিখিতই বলা যায়।

হেঁয়ালি রেখে কাজের কথায় আসি, বাংলা বইয়ের মরশুমে যখন লুপ্ত বইয়ের পুনঃপ্রকাশ নিয়ে তুমুল মাতামাতি, যখন শিকার কাহিনি, ভূতের গপ্পো, আত্মকথা থেকে শুরু নিমখাসা প্রেমোপাখ্যান পর্যন্ত নতুন মলাট-শোভিত হয়ে বিদ্বজ্জনের প্রসাদে সম্পাদিত হয়ে টীকা-ভাষ্য সম্বলিত হয়ে বেস্ট সেলার লিস্টিতে জায়গা পাওয়ার জন্য ঢুঁসোঢুঁসিরত, ঠিক তখন কারো কারো মনে হতেই পারে বাংলার এক বিশেষ সাহিত্য অবহেলিতই থেকে গেল। সেই সাহিত্যের ডাকনাম ‘পানু’।

ভদ্রভাষায় তাকে ‘ইরোটিকা’ বলে ডাকা যেতেই পারত। কিন্তু সে সব সাহেবদের দেশে হয়। ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যখন ‘আদার ভিক্টোরিয়ান’-রা ‘দ্য পার্ল’-এর মতো পত্রিকায় তাঁদের অবদান রাখছেন, বাংলায় তখন রেভারেন্ড জেমস লঙ-এর ধর্মযাজকসুলভ সেন্সরশিপে গোল্লায় যাচ্ছেন ভারতচন্দ্র বা তাঁর মতো চিরায়ত ইরোটিকা-র লেখদের সারা জীবনের সাধনা। তার পরে বাংলায় আর কি দেখা গিয়েছে বয়ঃসন্ধি-বান্ধব বইপত্র?

তল্লাশ করলে দেখা যায়, দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে অবিভক্ত বাংলায় সামরিক-সূত্রেই ঢুকে পড়েছিল পর্নোগ্রাফি। সে সব বই আজ কালেক্টর্স আইচেম। অ্যান্টিক কাগজে সেপিয়াটোনে ছাপা ‘অ্যালবাম’-এ শোভা পেত করসেট পরা ব্লন্ড সুন্দরীদের লাস্য। সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যাকে মায়াবি রাতে পরিণত করে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়কাল। ১৯৬০-এর দশক পশ্চিমে যদি ‘সেক্স-ও-ক্লক’ হয়ে থাকে, তবে সেই সময়টা বাঙালিরও হিকরি ডিকরি ডক।

‘জীবন যৌবন’, ‘রূপালি প্রজাপতি’, ‘নরনারী’ ইত্যাদি নামে প্রকাশিত হতে থাকে অসংখ্য পত্রিকা। এদের চেহারা সেই সময়ের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘উল্টোরথ’ বা ‘সিনেমা জগৎ’-এর অনুরূপ। ভিতরেও সেই সময়ের মাঝারি নামী সাহিত্যিকদের কয়েকটা উপন্যাস-ছোটগল্প। উত্তম-সুচিত্রার ফোটোফিচার। কিন্তু এসবের বাইরে থাকত আসল জিনিস। চূড়ান্ত ভাষায় লিখিত প্রকৃত পর্নোগ্রাফিতে উপস্থিত হতেন কালো সায়ায় আবৃতা রমা, বেলা, শিলাবৌদি। তাঁদের শয্যায় তুফান তোলা রমেশ, নরেশ, পরেশ-আদি দেওরের দল। গোলাপি ফানুসের দঙ্গল উড়তে থাকত বয়ঃসন্ধির আকাশে। রাতের এজমালি বিছানায় পাশবালিশহীনতায় কে বাঁচিতে চায়-সুলভ একাকীত্বকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেওয়া যেত এদের কারণেই।

হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, সে সব দিন কোথায়! মৌলালির মোড় ব্যেপে চমকাত ‘জীবন যৌবন’, ‘রূপালি প্রজাপতি’, ‘নরনারী’, ‘রাতের রজনীগন্ধা’। এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে ডিল হত। তার পরে হুইস্কির পাঁইটের মতো খবরের কাগজে মুড়ে তা চালান হয়ে যেত শিয়ালদাগামী নিত্যযাত্রীর ব্যাগে। দোজ ডেজ আর গন। গন উইথ দ্য উইন্ড। গন ফর এভার।

গ্লোবাল পরিসরে এমনটা ঘটতই। ইন্টারনেট জুড়ে যখন সাড়ে তিনটে মাউস-ক্লিকে নেমে আসে পর্ন-চলচ্ছবির দামামাগর্জন, সেখানে কে পড়বে ‘শিলাবৌদির কালো সায়া’-র কাহিনি? তা ছাড়া বাংলা চটির সাইটেও তো দিবারাত্র আপলোড হয়ে চলেছে কাঁচা-পাকা পানুগল্প। কে পড়বে?

জিজ্ঞাসা নিয়ে হাজির হটে হয়েইছিল মৌলালি জয়েন্টে। বাবু (নাম পরিবর্তিত) ৩৫ বছর ধরে ‘ম্যাগাজিন’ বিক্রি করছেন। তিনি জানালেন, ‘‘খদ্দের নেই। তাই সিডি রাখি।’’ পাশের স্টলে ‘ম্যাগাজিন’ রয়েছে, কিন্তু ষাটোর্ধ্ব ইয়াসিন (নাম পরিবর্তিত)-কে একই সঙ্গে চালাতে হয় সানগ্লাসের ব্যবসা। সিডি-ও চলে তলা তলায়। একটু এগোলেই সিডি-ডিভিডির বাজার। সেখানেও লভ্য এই সব ‘হট আইটেম’। কম্পিটিশন অসম। তবু লড়ে যেতে হবে। পেট কা সওয়াল।

বাবু জানালেন— ‘‘ছেলে কলেজে কমার্স পড়ছে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এ ব্যবসা এখানেই শেষ।’’ ইয়াসিন আরও হতাশ। তারকেশ্বর থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে সত্যিই পোষায় না।

কেবল ভুবনায়নকে কি দায়ী করা যায় এই ‘বিপর্যয়’-এর জন্য? তাহলে কেন ১৯৮০-র পর থেকে পাঠের অযোগ্য হয়ে যায় ‘বাংলা ইরোটিকা’? এ প্রশ্ন এই বিষয়ের অনেক গবেষকেরই। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০, বড় জোর ১৯৮০ সাল। তার পরে বাংলা সাহিত্যের ‘সিক সেক্টর’-এ পরিণত হয়। ততদিনে তার নামও পর্নোগ্রাফি থেকে ‘পানু’-তে পর্যবসিত। মহিমাও হাওয়া।

বয়ঃসন্ধির খেলনা বদলে গিয়েছে কখন। পরিবর্তিত সময়ের বাস্তবতায় রমেশ, নরেশ, পরেশ-রা সিম্পলি ‘নেই’। আর রমা, বেলা, শিলাবৌদিরা কোন ফাঁকতালে কিছু ধোঁয়াটে ফেসবুক প্রোফাইল হয়ে আক্ষরিক অর্থেই ‘ছায়ামানবী’।

রক্তমাংসের বাস্তবতায় এইসব নামও অবসলিট। অবসলিট সায়া-ব্লাউজের রহস্যময় আহ্বান। ‘‘জিনস-এ কি পানু জমে’’— প্রশ্ন এক চল্লিশোর্ধ্বের। একটা রেট্রো প্রয়োজন। উত্তর-ভুবনায়ন পর্বে যখন সব কিছুই সম্পাদিত ও সংকলিত, তখন ইতিহাসের কারণেই কি একটা সটীক সংকলন হেতে পারে না এই সব ‘পিছুটান’-এর?

মৌলালির মোড়ে হাওয়া ঘোরে। শীতের শুকনো হাওয়া। পাতা ওড়ে। ‘জীবন যৌবন’, ‘রূপালি প্রজাপতি’, ‘নরনারী’-র ছেঁড়া পাতা। পর্ন-মোচী কলকাতা সইয়ে নেয়, কেবল নিতে হয় বলেই।

আরএম-১৩/১৬/০১ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্যসূত্র: এবেলা)