ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে বইপত্র, তথ্যচিত্র ইত্যাদির উপর নির্ভর করতে হয়৷ জার্মানির উত্তরে একটি মিউজিয়াম ভাইকিং যুগকে কার্যত জীবন্ত করে তুলে তাদের সম্পর্কে অসাধারণ চিত্র তুলে ধরছে৷
ভাইকিংদের জীবনযাত্রা মোটেই দুর্বলচিত্তদের জন্য নয়৷ তীরধনুক সম্বল করে তাদের গোটা পরিবারের জন্য যথেষ্ট খাদ্য সংগ্রহ করতে হত৷ তীব্র শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে তাদের হাতে করে পরিচ্ছদ তৈরি করতে হত৷
সাধারণ যন্ত্রপাতি দিয়ে কাঠ খোদাই করে তা বেচাকেনাও করত তারা৷ ‘হাইটহাবু’ নামের ভাইকিং বসতি মধ্যযুগে উত্তর ইউরোপের অন্যতম প্রধান ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল৷ সেই মিউজিয়াম গ্রামে অভিনেতাদের দেখলে প্রায় এক হাজার বছর আগে ভাইকিংদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়৷ তাদেরই একজন কাই সাউশ৷
তিনি বলেন, ‘প্রকৃতির মাঝে ও প্রকৃতিকে নিয়ে ছিল সেই জীবন৷ তাদের অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল৷ আশেপাশের সব উপকরণ সম্পর্কে তাদের খুব ভালো ধারণা ছিল৷ নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলি কাজে লাগিয়ে তারা বাড়িঘর, জাহাজ, গাড়ি, দড়ি ইত্যাদি তৈরি করতে পারত৷ তারা যে পরিমাণ উৎপাদন করত আমরা তা ভাবতেই পারি না৷’
জার্মানির উত্তরে শ্লেসভিক হলস্টাইন রাজ্যে ডেনমার্কের সীমান্তে ‘হাইটহাবু’ গ্রাম আবস্থিত৷ সেখানে ৭টি বাড়ি হুবহু লুপ্ত বসতির মতো করে গড়ে তোলা হয়েছে৷ উত্তর সাগর ও বাল্টিক সাগরের মাঝে এক যোজকের উপর সেই বসতি গড়ে তোলা হয়েছিল৷ দামী ধাতু, অস্ত্রশস্ত্র ও পশুর চামড়া নিয়ে ব্যবসার আদর্শ অবস্থান ছিল সেটি৷ প্রত্নতত্ত্ববিদরা সেখানে অসংখ্য নিদর্শন পেয়েছেন৷
‘হাইটহাবু’ মিউজিয়ামের প্রধান ক্লাউস ফন কার্নাপ-বর্নহাইম বলেন, ‘আমার ঠিক পেছনে নবম, দশম ও একাদশ শতাব্দীর ভাইকিং বসতি হাইটহাবু দেখতে পাচ্ছেন৷ সবুজ মাঠ দেখলে প্রথম দর্শনে জায়গাটির গুরুত্ব বোঝা কঠিন৷ তবে প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটে, আসল সম্পদ মাটির নীচে রয়েছে৷ আমাদের পেছনে এক বর্গ সেন্টিমিটার জায়গাও নেই, যেখানে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি৷ আমরা বলি, হাইটহাবু প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে কলুষিত৷’
ঐতিহাসিক বসতির কাছে এক মিউজিয়ামে ভাইকিং আমলের অনেক নিদর্শন দেখা যায়৷ রাজ্যের অন্যতম সফল মিউজিয়াম হিসেবে সেটি পরিচিত৷ শুধু ২০১৭ সালেই এক লক্ষ তিরিশ হাজারেরও বেশি পর্যটক সেখানে এসেছেন৷ মিউজিয়ামে ভাইকিংদের জীবনাত্রার বেশ কিছু চমকপ্রদ দিক তুলে ধরা হয়েছে, যেমন তাদের উন্নত ব্রোঞ্জ ও রুপা দিয়ে তৈরি শিল্প এবং মুক্তার গয়নার প্রতি তাদের আকর্ষণ৷ অনেক দর্শক সে সব দেখে বিস্মিত হয়ে পড়েন৷
কেউ বলেন, ‘ভাইকিং বলতেই যুদ্ধবাজ মনে হতো৷ আমি কিন্তু এখানে সব কিছু ঘুরে দেখার পর বুঝছি, যে তারা ব্যবসায়ী হিসেবে আন্তর্জাতিকমনস্ক ইউরোপীয় ছিল, এমনকি বিশ্ব নাগরিকও বলা চলে৷’ অন্য একজন বলেন, ‘তাদের হাতে তৈরি শিল্প খুবই উন্নত মানের মনে হয়েছে৷ তাই তাদের শুধু যুদ্ধবাজ বলা চলে না৷ তারা আসলে খুবই সংস্কৃতিমনস্ক ছিল৷’
গোটা ইউরোপে ভাইকিংদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে হাইটহাবুর তুলনা মেলা ভার৷ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখলে ভাইকিংদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হয়৷ ক্লাউস ফন কার্নাপ-বর্নহাইম বলেন, ‘আমরা এখানে হাইটহাবু পারদ খুঁজে পেয়েছি, যার উৎস আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল৷ আমরা পিতলের বাট পেয়েছি, যার উৎস ফ্রান্স৷
সিন্ধুঘোটকের দাঁত উত্তরের শ্বেত সাগর থেকে এসেছে৷ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে হাইটহাবুকে হামবুর্গ বা রটারডামের মতো আজকের যুগের বন্দরের সঙ্গে তুলনা করা চলে, যেখানে নানা রকম পণ্য হাতবদল করা হত৷ হাইটহাবু দেখিয়ে দিচ্ছে, যে ভাইকিংরা শুধু যুদ্ধবাজ ছিল না, ধূর্ত ব্যবসায়ী হবার পাশাপাশি তারা প্রকৃতির সঙ্গেও একাত্ম হয়েও থাকতেন৷’
এসএইচ-১৯/০২/১৯ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র: ডয়চে ভেলে)