মানবদেহে ছাগলের অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপন

১৯৩০-এর সেপ্টেম্বরের সকাল। কানসাসের অলিতে গলিতে যেন উষ্ণতা ঝরে পড়ছে। সবার একটাই প্রশ্ন, এমনও হয়! যেন জ্ঞানশূন্য হয়ে কানসাস স্টেট মেডিকেল বোর্ডের একটি দল ছুটছে। তাদের সঙ্গী সাংবাদিকরাও। গন্তব্য কানসাস থেকে মিলফোর্ড। সেখানেই তাদের সামনে অসাধ্য সাধন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এক ‘চিকিৎসক’। যিনি আবার হাতুড়ে চিকিৎসক! এক রোগীর শরীরে ছাগলের অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।

কানসাস স্টেট মেডিকেল বোর্ডের দলটি ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে দেখল কীভাবে জীবন্ত ছাগলের নিম্নাংশ অসাড় করে তার দুটি অণ্ডকোষ কেটে বার করে আনলেন ওই চিকিৎসক। তার পাশের টেবিলে শুয়ে থাকা রোগীর শরীরে খুব সন্তর্পণে সেগুলো প্রতিস্থাপন করলেন।

এ অস্ত্রোপচার নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু এ একটি অস্ত্রোপচারই সারা বিশ্বে পরিচিতি এনে দিয়েছিল তাকে। ‘গোট গ্ল্যান্ড ডাক্তার’ হিসেবে এক নামে সবোই চেনেন তাকে।

তার প্রকৃত নাম জন ব্রিঙ্কলে। ব্রিঙ্কলের জন্ম ১৮৮৫ সালে উত্তর ক্যারোলিনাতে। তার বাবাও একজন হাতুড়ে চিকিৎসক ছিলেন। ১৬ বছর বয়সে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে ছোটখাটো কাজে ঢুকেছিলেন তিনি। কিন্তু বরাবরই বাবার মতো চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন। বাবার ওষুধের বই পড়ে চিকিৎসা নিয়ে বেশ কিছু জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তার পর গাড়িতে করে অলিতে গলিতে ওষুধ বেচার একটি সংস্থায় কাজে যোগ দিয়েছিলেন।

১৯০৮ সালে স্ত্রীকে নিয়ে শিকাগোয় চলে যান তিনি। সেখানে বেনেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই ব্রিঙ্কলে মানব শরীর সম্পর্কে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু তিন বছর পর মাইনে না দেওয়ায় তাকে কলেজ থেকে বার করে দেওয়া হয়। ফলে তার কাছে কোনো চিকিৎসকের সনদ ছিল না। এরপর তিনি নিজের জন্য একটি নকল সনদপত্র সংগ্রহ করেন।

তার পর তিনি গ্রিনভিলেতে চলে যান এবং সেখানে আরও এক সহযোগীর সঙ্গে বিশেষ এক তেল বিক্রি করতে শুরু করেন। মানুষকে বোকা বানিয়ে যৌনসঙ্গমের সময় পুরুষাঙ্গ শক্তিশালী করার কথা বলে এ ওষুধ বিক্রি করতেন তারা। কিন্তু কয়েক মাস এভাবে চলার পর তাদের প্রতারণা ধরা পড়ে যায়। ব্যবসা গুটিয়ে দুজনেই সেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন দুজনে।

এর পরই তার কানসাসে আসা। ওষুধ বিক্রির জন্য নকল সনদ কাজে লাগিয়েছিলেন এখানে। নিজেকে নারী ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। কানসাসের সেনা রিজার্ভ মেডিকেল বিভাগের চিকিৎসক হিসেবে কাজ পেয়ে যান। মাইনের টাকাতেই স্বপ্নপূরণ করেন ব্রিঙ্কলে। সে শহরের ইলেক্ট্রিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজে স্নাতক হন।

এরপর তিনি বিভিন্ন প্রাণীর শরীর নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তখনই নাকি তিনি জেনেছিলেন সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর প্রাণী ছাগল। ১৯১৭ সালে কানসাসে নিজে একটি ক্লিনিক খুলে ফেলেন। স্থানীয়দের সবরকম রোগেরই চিকিৎসা করতেন এ ক্লিনিকে। কিন্তু পরবর্তীকালে একজন সার্জেন হিসেবে তিনি সুনাম এবং অর্থ উপার্জন করেছিলেন।

১৯১৮ সালেই বিল স্টিটসওয়ার্থ নামে এক ব্যক্তি তার ক্লিনিকে এসেছিলেন। নিজের যৌন দুর্বলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন বিল। ব্রিঙ্কলে নেহাত মজা করেই তাকে বলেছিলেন, ছাগলের এক জোড়া অণ্ডকোষেই তার মুক্তি লুকিয়ে রয়েছে। এরপর ব্রিঙ্কলের পিছনে পড়ে যান বিল। ছাগলের অণ্ডকোষ নিজের শরীরে প্রতিস্থাপনের জন্য একপ্রকার নাছোড়বান্দা হয়ে পড়েছিলেন। তার জোরাজুরিতেই এ রকম একটা অস্ত্রোপচার করতে সম্মত হয়েছিলেন ব্রিঙ্কলে।

তবে এর ভিন্ন মতও রয়েছে। বিলের পরিবারের দাবি, ব্রিঙ্কলেই নিজের টাকার বিনিময়ে বিলকে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে রাজি করিয়েছিলেন। অস্ত্রোপচার সফল হয়। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন বিল। তারপর ঝড়ের গতিতে ব্রিঙ্কলের কথা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল।

ব্রিঙ্কলের ক্লিনিকের বাইরে রোগীদের লাইন পড়ে যেতে শুরু করে। প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন তিনি। তার কাছে প্রতিনিয়ত ছাগল সরবরাহ করতেন এক ব্যক্তি। এক নারীর দেহে ছাগলের ডিম্বাশয়ও প্রতিস্থাপন করেছিলেন। উপার্জিত অর্থে শহরের উন্নয়নেরও কাজে লাগিয়ে ছিলেন তিনি। একটি ডাকঘর, একটি ব্যাংক, রাস্তায় বৈদ্যুতিক আলো লাগিয়েছিলেন তিনি। একটি চিড়িয়াখানা খোলার চেষ্টাও করেছিলেন।

১৯২৩ সালে নিজের রেডিও স্টেশন চালু করেন। তার মাধ্যমে নিজের আরও প্রচার করতেন। প্রতিদিনের অস্ত্রোপচারের কথা এবং নিজের অভিজ্ঞতা এর মাধ্যমে সকলের কাছে পৌঁছে দিতেন তিনি।

খুব বেশি দিন এভাবে কাটাতে পারেননি। প্রাথমিকভাবে অস্ত্রোপচার সফল মনে হলেও তার রোগীরা ক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন। কারও সঙ্গী হলো ভয়ঙ্কর সংক্রমণ, কারও মৃত্যু ঘটল। ১৯৩০ সালে চিকিৎসকের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হয় তার। এর ছয় মাস পর রেডিও লাইসেন্সও বাতিল হয়ে যায়।

এরপর রাজনীতিতে হাত পাঁকাতে শুরু করেন ব্রিঙ্কলে। একাধিক বার কানসাসের গভর্নর হওয়ার ভোটে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রতিবারই পরাজিত হন।

এরপর টেক্সাসে গিয়েও লুকিয়ে তিনি ছাগলের গ্রন্থি মানব শরীরে প্রতিস্থাপনের কাজ করতে শুরু করেন। প্রচুর অর্থও উপার্জন করেন সেখান থেকেও। তার এবং স্ত্রীর জন্য ১৬ একর জমির উপর একটি প্রাসাদ বানিয়ে থাকতে শুরু করেন। বিলাসবহুল ছিল সেই প্রাসাদ।

টেক্সাসেও লোক ঠকানোর এ কাজ বেশি দিন চালাতে পারেননি। জানাজানি হতেই তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ৩০ লাখ ডলার জরিমানা নেওয়া হয় তার কাছ থেকে। ১৯৪১ সাল নাগাদ নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন তিনি।

জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে ফের ধুলোয় মিশে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি ব্রিঙ্কলে। তিন বার হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। ক্রমে স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে। ১৯৪২ সালের ২৬ মে সান অন্টোনিয়োতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যু হয় তার।

এসএইচ-১৩/১৮/২১ (অনলাইন ডেস্ক)