তাঁতি থেকে টয়োটার মালিক!

ব্যস্ত নগরীর রাজপথে চোখ মেলে তাকালেই দেখা যায় অসংখ্য চার চাকার যান, পাল্লা দিয়ে সবাই যেন ছুটছে অবিরত। দিনের পর দিন চার চাকার কারের সংখ্যা বাড়ছে। নানা রঙের, নানা সাইজের, হরেক রকমের সুবিধা-সম্পন্ন এক একটি কার। তবে এতসব ব্র্যান্ডের কারের মাঝে একটি নাম চোখে পড়বেই, যার নাম টয়োটা ।

জন্ম নিয়েছিলেন কৃষক পরিবারে, যিনি বড় হয়ে পরিচিতি পেয়েছিলেন জাপানের বিখ্যাত উদ্ভাবক হিসেবে। বলছিলাম সাকিচি টয়োডার কথা , যার হাত ধরেই বড় হয়ে ওঠে পারিবারিক টয়োডা ব্যবসাগুলো। শুরুটা টয়োডা অটোমেটিক লুম ওয়ার্কস বা তাঁত ব্যবসা দিয়ে। পরে যখন চারদিকে অর্থনৈতিক মন্দা,একদিকে কম কাপড় বুনন অপরদিকে দেশ-বিদেশে কাপড়ের চাহিদা কমায় বাসিন্দাদের আর্থিক অসঙ্গতিতে ফেলে দেয়, ঠিক তখনই অন্যদের মতো হতাশ না হয়ে সাকিচি টয়োডা নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সামান্য তাঁতি থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন টয়োটা কোম্পানির মালিক হিসেবে।

তখন সাকিচি টয়োডা মনোনিবেশ করেন যন্ত্রচালিত তাঁত উদ্ভাবনের দিকে। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে তিনি সফলও হলেন। কাজের সফলতায় নতুন কিছু উদ্ভাবনে তিনি আরও বেশি উৎসাহী হলেন। এ উৎসাহ আরও বেড়ে যায় তার টয়োডা অটোমেটিক লুম কোম্পানি উদ্ভাবিত একটি মেশিনের প্যাটেন্ট ১০ লাখ ইয়েনে বিক্রি করার সুযোগ পেয়ে। সে সময়ে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণের ওই অর্থ সাকিচি টয়োডা বিনিয়োগ করেন গাড়ির ইঞ্জিন বানানোর কাজে। নতুন উদ্ভাবনী কাজের দায়িত্ব দেন নিজের ছেলে কিচিরো টয়োডাকে।

১৯৩৫ সালে প্রথমবারের মতো জে-ওয়ান মডেলের গাড়ির ইঞ্জিন উদ্ভাবনে সক্ষম হন কিচিরো টয়োডা। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে টয়োডা মোটর কোম্পানি লিমিটেডের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৮ আগস্ট।শুরুর দিকে এই কোম্পানির নাম তয়োদা থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উচ্চারণ সুবিধার বিবেচনায় শব্দটিকে পাল্টে করা হয় টয়োটা।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টয়োটা ট্রাক বানাতো জাপানী বাহিনীর জন্য। যুদ্ধ শেষ হবার দু’বছর পর টয়োটা আবার সাধারণ যাত্রীদের জন্য প্রাইভেট কার বানানোর কাজ শুরু করে। ১৯৪৭ সালে মডেল এসএ (SA) বাজারে আসে। তবে কোম্পানির অবস্থা ভালো চলছিল না। ১৯৪৯ সালে পরিস্থিতি এতই খারাপ হয়ে যায় যে, দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে আসে তারা! নানা ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ায় সেই যাত্রায় বেঁচে যায় টয়োটা।পরের বছর মাত্র ৩০০টি ট্রাক বানিয়ে ব্যবসায় আবারও লস টয়োটার। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কোম্পানিটির তখন কর্মী ছাঁটাই আর বেতন কমানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না, ফলাফল হিসেবে পড়তে হয় শ্রমিক আন্দোলনের মুখে। শ্রমিকদের শান্ত করে ১৯৫০ সালের সেই ঝড়ও সামাল দিতে সক্ষম হয় কোম্পানিটি।

সে বছর কিচিরো অবসর নেন। তাঁত কোম্পানির সিইও তাইজো ইশিডা তখন আসেন টয়োটার প্রেসিডেন্ট হয়ে। কোরিয়ান যুদ্ধ শুরু হওয়ায় মার্কিন মিলিটারি পাঁচ হাজার গাড়ির অর্ডার দেয় টয়োটার কাছে। প্রায় মরতে বসা কোম্পানিটি এবার যেন বেঁচে ওঠে, শক্ত হাতে সব সামাল দেন তাইজো।

এছাড়া নিজ দেশ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টয়োটার কারখানা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের মধ্য দিয়ে টয়োটা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করে। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো জাপানের বাইরে ব্রাজিলে গাড়ির কারখানা স্থাপন করে। বর্তমানে জাপানে টয়োটা মোটর করপোরেশনের নিজস্ব ১২টি কারখানা, ১১টি সাবসিডিয়ারি অ্যাফিলিয়েট কারখানা ছাড়াও বিশ্বের ২৬টি দেশে মোট ৫১টি কারখানা রয়েছে। এগুলোতে গড়ে প্রতি বছর ৫৫ লাখ গাড়ি তৈরি হয়।

১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ‘পারিবারিক গাড়ি’-র চাহিদা বাড়ে। সে বছরের নভেম্বরেই জাপানের বাজারে ছাড়া হয় প্রথম করোলা, আর খুব দ্রুতই গাড়িটি পায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা। সেই যে শুরু হলো, সারা দুনিয়া-জুড়ে আজও রাস্তায় তাকালে সবচেয়ে বেশি যে গাড়ি চোখে পড়বে, সেটি হলো টয়োটা করোলা! টয়োটার ইতিহাসে আরেকটি সফল গাড়ি হলো ল্যান্ড ক্রুজার। ১৯৫১ সালের টয়োটা জীপ বিজে (Toyota Jeep BJ) থেকে আসলে এর যাত্রা শুরু, তবে ল্যান্ড ক্রুজার নামখানা প্রচলিত হয় ১৯৫৫ সাল থেকে টুয়েন্টি-সিরিজ বাজারে আসার সাথে সাথে। ল্যান্ড ক্রুজারের দশম সংস্করণ বর্তমানের লাইট ডিউটি প্রাডো এখনও গাড়ির দুনিয়ায় আছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে।

সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশের প্রাইভেট গাড়ির বাজার প্রায় একচেটিয়াভাবে দখল করে নেয় টয়োটা। এত বেশি টয়োটাপ্রীতির কারণ টয়োটার স্পেয়ার পার্টসের দাম কম ও সহজলভ্য। টয়োটার যাত্রা যে তাঁতশিল্প থেকে শুরু হয়েছিল, তা কিন্তু কখনোই বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। আজও চলছে সেই শিল্প, পার্থক্য কেবল এই- তখন কম্পিউটারের অস্তিত্ব ছিল না, আর আজ তাদের সেই তাঁতশিল্পের সবই কম্পিউটারচালিত। সেই তাঁতের সৌভাগ্য থেকেই তো টয়োটার জন্ম, বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষের প্রিয় ব্র্যান্ড হয়ে ওঠার সূচনা।

এসএইচ-১৮/১৬/২২ (অনলাইন ডেস্ক)