চলন্ত ট্রেনে সন্তান প্রসব

প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন শেষে রাজধানীতে ফিরছে মানুষ। এ যাত্রায় চলন্ত ট্রেনে এক নবজাতকের জন্ম হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী সিল্কসিটি এক্সপ্রেসে এ নবজাতকের জন্ম দেন পারুল নামে এক নারী।

প্রতিদিনের মতো শুক্রবার  সকালে রাজশাহী রেলস্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে সিল্কসিটি এক্সপ্রেস। ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফেরা কর্মব্যস্ত মানুষের ভিড় ট্রেনজুড়ে। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত আর সবুজ প্রান্তরের মধ্য দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনের উদ্দেশে। ট্রেনের মধ্যে যাত্রীদের কারো চোখ মোবাইলে আটকানো, কেউ আবার জানালা দিয়ে উপভোগ করছেন সবুজ প্রকৃতি। ততক্ষণে ট্রেন যমুনা সেতু পার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে টাঙ্গাইলের দিকে। সেই ট্রেনের ঙ বগির যাত্রী পারুল আক্তার।

পারুল আক্তারের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। থাকেন ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায়। স্বামী টিটু মিয়া পেশায় একজন রিকশা চালক। ঈদে রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলায় বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন পারুল আক্তার।

হঠাৎ পারুল আক্তারের চিৎকার। লোকজন এগিয়ে গেলে পারুল জানান, সে সন্তান-সম্ভবা। প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে তার। পারুলের পেছনের আসনেই বসা ছিলেন কুমিল্লা অ্যাপোলো প্লাস হাসপাতালের সেবিকা আলিফা আক্তার। আলিফার বাসা রাজশাহীর শালবাগান এলাকায়। চাকরির সূত্রে তিনি থাকেন কুমিল্লা। ঈদের ছুটি শেষে তিনি ফিরছিলেন কর্মস্থলে।

নারীর চিৎকার শুনে সঙ্গে সঙ্গে আলিফা বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। ততক্ষণে পুরো বগির যাত্রীরা জেনে গেছে বিষয়টা। ট্রেনের রানিং স্টাফরাও এগিয়ে আসেন। ট্রেনের খাবার কেবিন থেকে আনা হয় গরম পানি, ট্রেনের মধ্যে থাকা ফাস্টএইড বক্স নিয়ে আসে ট্রেন পরিচালকরা।

ওই নারীর জন্য যেন প্রার্থনা পুরো ট্রেনজুড়ে। ট্রেন কর্মীরাও যোগাযোগ করছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। নারীর অবস্থা বেশি খারাপ হলে প্রয়োজনে আশপাশের কোনো হাসপাতালের কাছাকাছি স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে পারুল আক্তারকে।

ইতোমধ্যে সব ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন সেবিকা আলিফা আক্তার। এসময় কয়েকজন নারী যাত্রীদের কাছে থেকে ওড়না নিয়ে ঘিরে ফেলে ওই আসনটি। ততক্ষণে মানুষের ভিড় সামাল দিয়ে সার্বিক নিরাপত্তা দিতে হাজির রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরাও। ইতোমধ্যে ট্রেনের মাইকে কোনো ডাক্তার থাকলে তার সাহায্য চেয়ে বার বার ঘোষণা দেওয়া হয়। ট্রেনটি টাঙ্গাইলের কাছাকাছি স্থানে এক ফুটফুটে ছেলে সন্তানের জন্ম দেন।

ট্রেনের ঘটনা শুনে সেখানে ছুটে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. গুলশান আরা। তিনি ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি রাজশাহীতে এসেছিলেন। ছুটি শেষে ফিরছিলেন কর্মস্থলে।

সময় সংবাদকে ডাক্তার গুলশান আরা জানান, শিশু ও তার মা সে সময় সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিল। একজন মায়ের নিরাপদ প্রসবে ভূমিকা রাখতে পেরে খুশি গুলশান আরা।

সময় সংবাদকে আলিফা আক্তার জানান, পারুলের কষ্ট দেখে বসে থাকতে পারেননি তিনি। হাতের কাছে কোনো প্রকার চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও সাহস নিয়ে এগিয়ে যান।

আলিফা বলেন, নতুন একটা প্রাণকে নিরাপদে পৃথিবীতে আনতে পেরে তিনি ভীষণ খুশি। মানুষের প্রয়োজনে মানুষ এগিয়ে এলেই সুন্দর হবে পৃথিবী। আলিফার সাহসী ভূমিকার প্রশংসা যাত্রীসহ রেল কর্মকর্তাদের মুখে মুখে।

সেই খবর পৌঁছে যায় ঢাকার রেল কর্মকর্তাদের কাছেও। ঢাকা রেলওয়ের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক শফিকুর রহমানের নির্দেশে প্রসূতি মায়ের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে রেলওয়ে। ইতোমধ্যে ট্রেন পৌঁছে যায় গাজীপুরের জয়দেবপুর রেলস্টেশনে। সেখানে সব ধরনের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে যান ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার শওকত জামিল মোহসি।

মোহসি জানান, কমলাপুরে প্রস্তুত করা হয় রেলের মেডিকেল টিম। রেলওয়ে হাসপাতাল থেকে আনা হয় অ্যাম্বুলেন্স। প্রসূতি মা ও বাচ্চার চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থা করে কমলাপুরে নেওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্সে পারুল আক্তারকে পৌঁছে দেওয়া হয় তার ঢাকার বাসায়।

তিনি বলেন, বাচ্চাটির নাম সিল্ক অথবা রাজ প্রস্তাব করা হয়েছে। বাচ্চা ও মা দুজনেই সুস্থ আছে। চলন্ত ট্রেনে নতুন প্রাণের আগমন যেন পরিবার থেকে দূরে থাকা রেলকর্মীদের ঈদ আনন্দের চেয়েও বেশি কিছু।

এসএইচ-২৭/০৬/২২ (অনলাইন ডেস্ক)