ভারতে তিন সপ্তাহে ৩৮ লাখ বিয়ে, খরচ পাঁচ লাখ কোটি রুপি

ভারতে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে বিয়ের মৌসুম। দেশটির ৩০টি বড় শহর থেকে পাওয়া হিসেবে দেখা গেছে, অন্তত ৩৮ লাখ বিয়ে হবে আগামী কয়দিনে। যার জন্য কম করে চার লাখ ৭৪ হাজার কোটি রুপি খরচ করা হবে। ব্যবসায়ীদের একটি সর্বভারতীয় সংগঠন এই হিসেব সামনে এনেছে।

এসব বিয়ের অনুষ্ঠানে এমন ৫০ হাজার বিয়েও আছে, যার প্রত্যেকটিতে এক কোটি রুপিরও বেশি খরচ হবে আবার সাত লাখ বিয়ের বাজেট তিন লাখ রুপির নিচে থাকবে। আরও ৫০ হাজার বিয়ের বাজেট ৫০ লাখ রুপি। কলকাতায় এক বাঙালি পরিবার বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়েতে মোটামুটিভাবে ২০ লাখ রুপি খরচ করতে চলেছে এই মৌসুমেই।

আবার এক লাখ রুপিরও কমে ছেলের বিয়ের আয়োজন করতে চলেছেন, এমন অভিভাবকও আছেন। ওই ব্যবসায়ী সংগঠনটি বলছে, শুধু দিল্লিতেই চার লাখ বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে, যাতে মোট সোয়া এক লাখ কোটি রুপি ব্যয় হবে। তারা দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতাসহ ভারতের ৩০টি শহরের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে।

গত বছর এই একই বিয়ের মৌসুমে ভারতে ৩২ লাখ বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল আর সেই সব বিয়ের আয়োজনে খরচ হয়েছিল পৌনে চার লাখ কোটি রুপি।

• বিয়ের খরচে রেকর্ড

ব্যবসায়ীদের সংগঠন কনফেডারেশন অব অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্সের সাধারণ সম্পাদক প্রবীণ খাণ্ডেলওয়াল বিবিসিকে বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী আর বেসরকারি ক্ষেত্রের কর্মীরা মাস কয়েক আগেই বোনাস আর ইনসেন্টিভ পেয়েছেন। তাই মানুষের হাতে ছেলে মেয়ের বিয়েতে খরচ করার মতো যথেষ্ট অর্থ রয়েছে এখন।

‘‘বেশ কয়েক বছর কোভিডের ভয়ে মানুষ আনন্দ উৎসবে সেরকম জাঁকজমক করতে পারেনি। এবছর একেবারে নির্ভয়ে মানুষ যেমন দিওয়ালি পালন করার জন্য রেকর্ড পরিমাণ খরচ করেছে, তেমনই শীতকালের এই বিয়ের মৌসুমেও আরেকটা রেকর্ড হতে চলেছে। দিওয়ালিতে সারা দেশে তিন লাখ ৭৫ হাজার কোটি রুপির ব্যবসা হয়েছে। বিয়ের মৌসুম সেই পরিমাণকেও ছাড়িয়ে যাবে।’’

• কোন খাতে কত খরচ
ভারতের অতি-জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে শাদির অনুষ্ঠানকে সাধারণভাবে ‘দ্য বিগ ফ্যাট ইন্ডিয়ান ওয়েডিং’ বলা হয়ে থাকে। খাণ্ডেলওয়াল বলছিলেন, বিয়ের কেনাকাটার মধ্যে শাড়ি, লেহেঙ্গা ইত্যাদির জন্য মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশ খরচ করেন ভারতীয়রা। আর গয়নাগাঁটিতে ১৫ শতাংশ বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের পেছনে পাঁচ শতাংশ ব্যয় হয়।

একটি বিয়ের আয়োজনে মোট যা খরচ হয়, তার অর্ধেক যায় কেনাকাটা করতে, বাকি অর্ধেক ব্যয় হয় বিভিন্ন পরিষেবা কিনতে। আর বিয়ের আয়োজনের এসব পরিকল্পনা করে দেওয়ার জন্য আছেন ওয়েডিং প্ল্যানাররা।

বিয়ের মৌসুমের শুরুতেই সেরকমই একটা বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা সাজিয়ে দিয়েছেন দিল্লির ইভেন্ট ম্যানেজার ও ওয়েডিং প্ল্যানার সীরাট গিল। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘‘বিয়ের অনুষ্ঠানের দিনে যা খরচ হয়, মোটামুটিভাবে তার ৫০ শতাংশ অনুষ্ঠান-স্থল ভাড়া আর কেটারিংয়ে ব্যয় হয়। এর বাইরে ডেকোরেশনের জন্য ১৫%, ছবি আর ভিডিও তোলার জন্য ১০% খরচ হয়, সাত শতাংশ মদের জন্য, পাঁচ শতাংশ বিনোদন, তিন শতাংশ কনে আর আত্মীয়দের মেকআপ আর ১০ % অন্যান্য বিভিন্ন পরিষেবার পেছনে খরচ করা হয়, যার মধ্যে আমাদের মতো ওয়েডিং প্ল্যানারদের ফি-ও থাকে।’’

• একই ধরনের বিয়ের অনুষ্ঠান
ভারতীয় সিনেমা-সিরিয়ালে যেরকম বিয়ের অনুষ্ঠান দেখা যায়, অনেকটা সেভাবেই নিজেদের বিয়ের অনুষ্ঠানকে সাজাতে চান বেশিরভাগ বর-কনে। সেজন্য উত্তর ভারতীয় বেশির ভাগ বিয়ের অনুষ্ঠান অনেকটা একই রকমের হয়ে যায়; কোনটা কার বিয়ের অনুষ্ঠান, আলাদা করে চেনার উপায় থাকে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।

ওয়েডিং প্ল্যানার সীরাট গিল বলছিলেন, কাপলরা, বিশেষত বিয়ের কনেরা সেলিব্রেটি আর সামাজিক মাধ্যমে ট্রেণ্ডিং বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো দেখেই নিজেদের বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা সাজান। একেকটা মৌসুমে যেটা ট্রেণ্ড করে, বেশিরভাগ কনে সেটাই অনুকরণ করেন। তার ফলে সারা দেশে মোটামুটিভাবে একই ধরনের বিয়ের অনুষ্ঠান দেখা যায়।

‘‘অনেক বর-কনেই যেমন অতি-জাঁকজমক পূর্ণ অনুষ্ঠান করার দিকে ঝোঁকেন, তেমনই কোভিড পরবর্তী পর্যায়ে আমরা দেখছি এরকম বিয়ের সংখ্যাও বাড়ছে, যেখানে পাত্র-পাত্রীরা বিয়ের অনুষ্ঠানটাকে একেবারেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে সারছেন খুব বেশি খরচ না করে।’’

• বাঙালি বিয়ের অনুষ্ঠান
উত্তর ভারতীয় বিয়ের রীতি নীতি অনুসরণ করে অনেক বাঙালি পরিবারেও আজকাল ‘মেহেন্দি’ আর ‘সঙ্গীত’র মতো অনুষ্ঠান বিয়ের আয়োজনের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। বিয়ের অনুষ্ঠান-স্থলের সাজ সজ্জাও অনেক ক্ষেত্রে উত্তর ভারতীয় বিয়ের অনুষ্ঠানের মতোই করা হয়।

কিন্তু তার বাইরে বাঙালি পরিবারে বিয়ের যে চিরাচরিত রীতি, সেই অনুযায়ী বিয়ের সংখ্যাও অনেক। যে পুরোনো রীতি মেনেই ২৮ নভেম্বর মেয়ের বিয়ে দেবেন কলকাতার বাসিন্দা চৈতালি চ্যাটার্জী।

তিনি বলছিলেন, ‘‘আমাদের পুরোনো বাড়ি, গোটা বাড়ি আলো দিয়ে সাজাচ্ছি, অনেক আত্মীয়স্বজন টানা কয়েকদিন থাকবেন। বিয়ে আর বৌভাতের দিন বাদ দিয়ে তাই প্রতিদিন দু’শ লোকের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।’’

‘ওইসব ওয়েডিং প্ল্যানার-ট্যানার আমাদের বাড়িতে চলবে না। আমরা যেভাবে পরিবারে বিয়ে দেখে এসেছি, সেভাবেই মেয়ের বিয়ে দেব। নাচ-গানও হবে, তবে সেসব বাড়ির মেয়েদের নিজেদের মধ্যেই।’’

‘‘আমার মেয়ে সামাজিক মাধ্যমে ওইসব জাঁকজমক পূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান যে দেখেনি তা নয়, কিন্তু ও নিজে চায় একেবারে চিরাচরিত ভাবে বিয়ে করতে। সেভাবেই আয়োজন হচ্ছে,’’ বলছিলেন চ্যাটার্জী।

• খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ
ব্যবসায়ী সংগঠনটি যেমন বলছে মানুষের হাতে অর্থ এসেছে, তাই ছেলে মেয়ের বিয়েতে ‘হাত খুলে’ খরচ করছেন তারা, তেমনই খুব কম বাজেটেও বিয়ের অনুষ্ঠান করছেন, এমন এক অভিভাবকের সঙ্গেও কথা বলেছে বিবিসি।

নিজের নাম প্রকাশ না করতে চেয়ে তিনি বলছিলেন, ছেলের বিয়েতে মোটামুটি ৭০-৮০ হাজার রুপি খরচ হয়ে যাবে। বছর দশেক আগে শালার বিয়ে দিয়েছিলাম, এখন তো সব কিছুরই খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সে সোনার দাম বলুন আর অন্যান্য উপকরণ। কিন্তু করতে হচ্ছে, একটাই তো ছেলে! বিবিসি বাংলা।

এসএ-০৯/১১/২৩ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)