পালাচ্ছে রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা
১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ যুদ্ধ জয়ের দ্বারপ্রান্তে। লাল-সবুজ পতাকার ঢেউ দেশের আনাচে-কানাচে। একের পর এক হানাদারমুক্ত হচ্ছে দেশের প্রতিটি জেলা। দিশাহারা পাক হানাদাররা। আকাশ-নৌ ও স্থলে শাণিত আক্রমণে দিশাহারা পাক সৈন্যরা। সুশিক্ষিত ও আধুনিক সমরসজ্জায় সজ্জিত হানাদাররা বাংলার কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীর কাছে পর্যুদস্ত। পাক হানাদার ও তাদের দোসররা আত্মসমর্পণের পথ খুঁজছে।
জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছে হানাদারদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা। রক্তক্ষরা একাত্তরের এদিনে আকাশ বাণীর মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান মানেকশ বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। অন্যদিকে একের পর এক জেলা হানাদারমুক্ত করে বিজয় কেতন উড়িয়ে চারদিক থেকে ঢাকায় আক্রমণ করার প্রস্তুতি চলছে অকুতোভয় মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর।
মূলত সারাদেশেই পাক হানাদাররা বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। আকাশ ও স্থলে শাণিত আক্রমণে দিশাহারা পাক সৈন্যরা। লাখো প্রাণ আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে একটি নতুন রাষ্ট্রের আলো ছড়াতে শুরু করে। স্বাধীন হয়ে উঠতে শুরু করে বাংলার অবারিত প্রান্তর। পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ মরিয়া মুক্তিপাগল বাংলার দামাল ছেলেরা।
একাত্তরের এদিন ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন সকালে মিত্রপক্ষের সামরিক নেতারা পূর্ব রণাঙ্গনের সমগ্র পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখলেন, তাদের প্রথম লক্ষ্য সফল হয়েছে। বাংলাদেশের নানা খ-ে পাকিস্তানী বাহিনী বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ। কোনদিক দিয়ে তাদের পালানোর পথ নেই। দক্ষিণে পাকিস্তানী বাহিনীর একটি অংশ আটকা পড়েছে। উত্তরে গোটা পাকিস্তানী বাহিনীও ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার মধ্যবর্তী ৩/৪টি অঞ্চলে অবরুদ্ধ। প্রায় একটি ব্রিগেড হিলির কাছে অবরুদ্ধ।
আর একটি ব্রিগেড আটকা পড়ে জামালপুরে। সিলেটের দিকে যে বাহিনীটা ছিল, কার্যত তা খতম হয়ে গেছে। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ আরেকটি ব্রিগেড। আরেকটি পাকিস্তানী বাহিনী অবরুদ্ধ চট্টগ্রামে। একটির সঙ্গে অন্যটির যোগ দেয়ার কোন সুযোগ নেই। ঢাকার দিকে পিছু হঠাও কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
সার্বিক এই চিত্র অবলোকন করে মিত্রবাহিনী তখন ৩টি ব্যবস্থা নিল। ১. গোটা পাকিস্তানী বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হলো। ২. জেনারেল জগজিৎ সিংকে বলা হলো তার ৩ কলাম সৈন্য দ্রুত ঢাকার দিকে এগিয়ে নিতে। ৩. একটি ব্রিগেডকে হালুয়াঘাটের দিক থেকে ময়মনসিংহের দিকে নিয়ে আসা হলো। যুদ্ধের শুরুতেই ভারতীয় বাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। ৮ ডিসেম্বর আবার তার সেই আহ্বান আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হয়। জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের কথা বললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এ আশ্বাস দিলেন- আত্মসমর্পণ করলে পাকিস্তানী বাহিনীর প্রতি জেনেভা কনভেশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে।
জেনারেল মানেকশ বলেন, ‘আমরা জানি আপনারা (পাকিস্তানী বাহিনী) পালানোর জন্য বরিশাল আর নারায়ণগঞ্জের কয়েক জায়গায় জড়ো হচ্ছেন। কিন্তু আমি সমুদ্রপথে পালানোর সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি। এজন্য নৌবাহিনীকে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখনও যদি আপনারা পরামর্শ না শোনেন এবং মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করেন তাহলে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কেউ আপনাদের রক্ষা করতে পারবে না।’
ভারতীয় সেনাবাহিনীর এমন হুঁশিয়ারি শুনে পর্যুদস্ত পাকি হানাদারদের মনোবল আরও ভেঙ্গে পড়ে। কোথাও প্রতিরোধ তো দূরের কথা, পালানোর পথ খুঁজতেও মরিয়া তারা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত। আত্মসমর্পণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। এটা বুঝতে বাকি রইল না হানাদার বাহিনীর নেতাদের। তাই আত্মসমর্পণের আগে রাজাকার-আলবদরদের নিয়ে মরণ কামড় দিতে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকে পাকি জেনারেলরা।
বাংলাদেশ যুদ্ধজয়ের দ্বারপ্রান্তে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভারত-পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব পাস করে। সাধারণ পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, পাকিস্তানকে অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে হবে। উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিও দাবি করেন।
এসএইচ-০১/০৮/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)