বিশ্বব্যাপী আদমপাচার বাড়ছে উদ্বেগজনকহারে

বিশ্বব্যাপী আদম পাচারের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে ২০১৬ সালে। পাশাপাশি পাচারকারিদের শাস্তি প্রদানের ঘটনাও অনেক বেড়েছে ১৩ বছরের ব্যবধানে।

২৯ জানুয়ারি উদ্বেগজনক এসব তথ্য প্রকাশ করেছে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরের ড্রাগ এ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) সম্পর্কিত অফিস। আদমপাচারের এ রিপোর্ট জাতিসংঘ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শহরের কান্দাপাড়া পতিতালয়ে দুই তরুনীর ছবিসহ। চাকরির কথা বলে এক ব্যক্তি তাদেরকে শহরে এনে কান্দাপাড়া পতিতালয়ে বিক্রি করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ছবিটি ২০০৯ সালের।

ইউএনওডিসির নির্বাহী পরিচালক ইউরি ফেডোটফ জানান, এ রিপোর্ট তৈরির লক্ষ্য আদম পাচারকারিদের গতিবিধি এবং পাচারের অবলম্বন, বাহন, পথে-ঘাটের দালাল, আশ্রয়দাতা ইত্যাদি তথ্য নখদর্পণে আনা। পাচারকারিদের নেটওয়ার্ক গুড়িয়ে দিতে হলে এসব তথ্য জানা থাকতে হবে। এর সাথে এই চক্রের শিকার এবং দুর্বৃত্তদের খবরাখবরও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে বলেই বিভিন্ন দেশে বহু পাচারকারির জেল-জরিমানা হয়েছে।

এটা উদঘাটিত হয়েছে যে, বহুদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীকে বিশেষভাবে পারদর্শী করা হয়েছে পাচারকারিদের শনাক্ত করার মধ্য দিয়ে গ্রেফতারের ব্যাপারে। সে পথ ধরেই জেল-জরিমানার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, পাচারকারিদের কাছে থেকে উদ্ধার পাওয়া নারী-শিশুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বহুদেশে জোরদার করা হয়েছে।

প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে ২০ হাজারেরও কম আদমপাচারকারি গ্রেফতার হয়। সে সংখ্যা বেড়ে ২০১৬ সালে ২৫ হাজারের বেশি হয়েছে। বিভিন্ন দেশেই আদম পাচারকারিদের নেটওয়ার্কের তথ্য সঠিকভাবে কর্তৃপক্ষের গোচরে আনার প্রক্রিয়াও জোরদার হয়েছে।

ডাটা কালেকশনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার হবার মধ্য দিয়ে দুর্বৃত্তদের পুলিশ প্রশাসনের চৌহদ্দিতে আনা সহজ হচ্ছে। ২০০৯ সালে মাত্র ২৬ দেশে আদম পাচারের বিস্তারিত তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা থাকলেও এখন তা ৬৫ দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে বলে ইউএনওডিসির এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্রসার ঘটার সাথে সাথে দুর্বৃত্ত দমনের কার্যক্রমও জোরদার হচ্ছে।

ইউএনওডিসির কর্মকর্তারা অবশ্য উল্লেখ করেছেন, আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশেই পাচারকারিদের শনাক্ত এবং গ্রেফতারের ভালো কাঠামো না থাকায় অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ওরা ধরা পড়ছে না কিংবা পাচারের শিকাররা উদ্ধার হচ্ছে না বলে আদম পাচারের ঘটনা কমেছে বলে মনে করার অবকাশ থাকতে পারে না। এ ধরনের প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আদমপাচারকারিরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে ইউএনওডিসি এই রিপোর্টে।

ইউএনওডিসি’র নির্বাহী পরিচালক উল্লেখ করেছেন, এখনও নারী ও তরুনীরাই প্রধান টার্গেট পাচারকারিদের। গত কয়েক বছরে যে সব ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়েছে তার সিংহভাগই হচ্ছেন নারী এবং ৩৫% কে বেশ্যাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়েছিল।

এ রিপোর্টে বলা হয়েছে, পশ্চিম আফ্রিকায় সবচেয়ে বেশী শিশু (বালক-বালিকা) কে যৌনদাসী/দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল। অপরদিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভিকটিমের মধ্যে নারী-পুরুষ-শিশুরা ছিল। সেন্ট্রাল এশিয়ার বয়স্ক পুরুষেরাও বেশি পাচার হচ্ছে। সেন্ট্রাল আমেরিকা এবং ক্যারিবিয় দেশসমূহের তরুণীরাই আদমপাচারকারিদের মূল টার্গেট। যৌন-ব্যবসায় বাধ্য করা হয় এসব তরুনীদের।

প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাচারের শিকার তরুনীদেরকে অধিক বয়সী পুরুষের সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য করা করা হয় সাধারণত দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয়ায়। সেন্ট্রাল এবং সাউথ আমেরিকায় শিশুদেরকে দত্তক দেয়া হয়। ওয়েস্টার্ন এবং সাউদার্ন ইউরোপে পাচারকৃতদের গুরুতর অপরাধ কর্মে বাধ্য করা হয়। নর্থ আফ্রিকা, সেন্ট্রাল এবং ইস্টার্ন ইউরোপে পাচারকৃতদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বিক্রি করা হয়।

৭ বছর বয়সী রানী হককে ভারতীয় একটি পরিবার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে প্রথমে তাকে বর্বরোচিত কাজে বাধ্য করা হয়। এরপর তাকে কানাডায় বিক্রি করা হয়। এক কানাডীয় তাকে দত্তক নেয়। এরপর পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পরই সে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী কর্তৃক উদ্ধার হয়। সেই যুবতী রানী ইউএনওডিসি-কে বলেছেন, পাচারের উদ্দেশ্যে অপহরনকারীদেরকে হোটেল-রেস্টুরেন্ট, মৎস্য উৎপাদন কেন্দ্র, পতিতালয়,খামার বাড়ি, বসতবাড়িতেও রাখা হয়।

‘যুক্তরাষ্ট্রে আনার পর আমাকে ছোট্ট একটি গুহায় আটকে রাখা হবে, যেখান থেকে আমি বের হতে পারবো না। এমনি আচরণ করা হয় অন্যদের সাথে। আমাকেও তেমন অসহনীয়-অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে হয়’-উল্লেখ করেছেন রানী।

এসএইচ-১৬/৩১/১৯ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)