পরিবারতন্ত্রেই ডুবল শ্রীলঙ্কা?

বছরের পর বছর ধরে শ্রীলঙ্কার অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। কিন্তু সেই ক্ষমতাও শেষ পর্যন্ত বিফলে গেছে। বিরোধী দল এবং দেশের জনগণের তীব্র ক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন মাহিন্দা। চাপের মুখে রয়েছেন তার ভাই এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেও। এ ঘটনাকে দেখা হচ্ছে শ্রীলঙ্কার রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে অপ্রীতিকর পরিবর্তন হিসেবে। তবে রাজাপক্ষে পরিবারের ওপর সাধারণ মানুষের এত ক্ষোভের কারণ কী? সবকিছু ছাপিয়ে ঘুরেফিরে সেই প্রশ্নই সামনে আসছে বারবার।

বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ থেকে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট। আর সেই ঋণ শোধ করতে গিয়ে রিজার্ভে ঘাটতি। আবার রিজার্ভ ঘাটতির কারণে আমদানি ব্যয় মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এসবই ধীরে ধীরে দেউলিয়াত্ব ডেকে আনে শ্রীলঙ্কার জন্য। আর সংকটের এ আগুনে ঘি ঢালে দেশটির রাজনৈতিক অচলাবস্থা।

বছরের পর বছর ধরে শ্রীলঙ্কা শাসন করে আসা রাজাপক্ষে পরিবারের বিরুদ্ধে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ। এর মধ্যে অভিযোগ বেশি সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে। বলা হয়, ক্ষমতায় আসার পর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে নিজ পরিবারের সদস্যদের বসানোই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে মাহিন্দার জন্য। রাজাপক্ষে পরিবারের একনায়কতন্ত্রের ইতিহাসও বেশ দীর্ঘ, যা জানতে যেতে হবে আরও পেছনে।

মাহিন্দা রাজাপক্ষে যখন দ্বিতীয় মেয়াদে (২০১০-২০১৫) শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট, সে সময় সরকারের শীর্ষস্থানীয় প্রায় অর্ধশতাধিক পদে ছিলেন রাজাপক্ষে পরিবারের সদস্যরা। কোনো দেশের শাসন ব্যবস্থায় একই পরিবারের এমন আধিপত্য বিরল। গোতাবায়া ও মাহিন্দা রাজাপক্ষের নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রিসভাতেও ছিলেন রাজাপক্ষে পরিবারের ১১ সদস্য। তবে রাজাপক্ষে পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তি মনে করা হয় মাহিন্দা রাজাপক্ষকে।

মাহিন্দা রাজাপক্ষের জন্ম শ্রীলঙ্কার স্বনামধন্য এক রাজনৈতিক পরিবারে। তার বাবা ডি. এ. রাজাপক্ষ রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতাকামী, সংসদ সদস্য এবং বিজেনন্দা ডাহানায়েকে সরকারের কৃষি ও ভূমিমন্ত্রী ছিলেন। আর দাদা ডি.এম. রাজাপক্ষ ছিলেন ১৯৩০-এর দশকে হাম্বানটোটার স্টেট কাউন্সিলর।

১৯৬৭ সালে বাবার মৃত্যুর পর এসএলএফপি দলের প্রার্থী হিসেবে রাজনীতিতে আসেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। আর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মাত্র ২৪ বছর বয়সে শ্রীলঙ্কার সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৭ সালের সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হলেও ১৯৮৯ সালে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে সংসদে হাম্বানটোটার প্রতিনিধিত্ব করেন মাহিন্দা।

দেশটির ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার নেতৃত্বাধীন পিপলস অ্যালায়েন্স বিজয়ী হলে রাজাপক্ষ নিযুক্ত হন শ্রমমন্ত্রী হিসেবে। ১৯৯৭ সালে মন্ত্রণালয় পুনর্গঠনের আগ পর্যন্ত এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তবে ২০০১ সালে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) পিপলস অ্যালায়েন্সকে পরাজিত করলে পদচ্যুত হন সরকার থেকে।

এরপর ২০০৪ সালের সংসদ নির্বাচনে জয় পেয়ে শ্রীলঙ্কার ত্রয়োদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। আর শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির হয়ে ২০০৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় ছিনিয়ে নেন প্রতিপক্ষ ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির প্রধান রনীল বিক্রমাসিংহের কাছ থেকে।

২০১৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। সে সময় ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, নির্বাচনের ফল বানচালের চেষ্টা এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তবে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে আবার ক্ষমতায় ফেরেন মাহিন্দা। আর প্রেসিডেন্ট হন তার ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে। দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধেই অসংখ্য দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

সমালোচকদের মতে, ক্ষমতায় থাকাকালে নিজ পরিবারের আর্থিক লাভের জন্য দেশের সম্পদ লুট করার পথ প্রশস্ত করেছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। আর পারিবারিক এ দুর্নীতিই শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে গেছে দেউলিয়াত্বের পথে, পদ ছাড়তে বাধ্য করেছে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে।

মাহিন্দা রাজাপক্ষে পদত্যাগ করলেও ক্ষোভ কমেনি শ্রীলঙ্কানদের। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবিতে এখনো সহিংস বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। যদিও নিজের অবস্থানে অনঢ় গোতাবায়া। চেষ্টা করছেন সর্বদলীয় সরকার গঠন করে নিজের পদ ধরে রাখতে। তবে সেই চেষ্টায় গোতাবায়া রাজাপক্ষে সফল হবেন, নাকি নিজের ভাইয়ের মতোই মেনে নেবেন অপমানজনক প্রস্থান, সময়ই তা বলে দেবে।

এসএইচ-১৩/১১/২২ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)