শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমে নিবন্ধ

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে। দেশটির গুরুত্বপূর্ণ এই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি কলামে (নিবন্ধ) বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নেতৃত্ব থেকে পাকিস্তানের অনেক কিছুই শেখার আছে।

মঙ্গলবার ‘টেকঅ্যাওয়েজ ফ্রম বাংলাদেশ’স লিডারশিপ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন। প্রবন্ধটি লিখেছেন লেখক ও কলামিস্ট সাহেবজাদা রিয়াজ নুর। একসময় পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের মুখ্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

নিবন্ধের শুরুতেই সাহেবজাদা রিয়াজ নূর বলেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। এই উন্নয়নের কৃতিত্ব দেশটির নেতৃত্বকেই দেয়া যেতে পারে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন। এই সেতুকে দেশের ‘গর্ব ও সামর্থ্যের প্রতীক’ আখ্যা দিয়েছেন তিনি।

এরপর তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ১৯৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিষয় ও পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে অর্থনৈতিক নীতির ভারসাম্য তৈরির কাজে মনোযোগ দেন তিনি।

তার কথায়, শেখ হাসিনা তার বাবার (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) সমাজতান্ত্রিক এজেন্ডা থেকে বাজারভিত্তিক পুঁজিবাদী প্রবৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি অন্যান্য এশিয়ান দেশ থেকে শিখেছেন, যাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের ভিত্তি চারটি। এই ভিত্তিগুলো হলো: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক উন্নয়ন, রফতানিকেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বাণিজ্যনীতি উদারীকরণ ও আর্থিক সংযম।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে প্রবন্ধে রিয়াজ নুর আরও বলেন, ‘১৯৭১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে জবাবদিহির অভাব এবং সামরিক শাসনের প্রভাব থাকলেও ২০০৯ সাল থেকে সেনাবাহিনী কার্যত আড়ালেই রয়েছে। বাংলাদেশে বেসামরিক সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনা খুবই কম।

তার ভাষায়, ‘যদিও দেশটির গণতান্ত্রিক ইতিহাস নিষ্কলঙ্ক নয়, বাংলাদেশ সরকার দুর্নীতি ও অদক্ষতার বিষয়ে জনসাধারণের সমালোচনার বিষয়টি ভালোভাবেই এড়াতে সক্ষম হয়েছে। সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা খুব বেশি থাকলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দূরদর্শী চিন্তা ধারণ করেছেন এবং তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতিই দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের একমাত্র উপায়।’

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক বলেন, বিরোধীদের দমনের কিছু অভিযোগ থাকলেও ১৫ বছর ধরে টেকসই প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

‘১৯৭০ সালে দেশটি পাকিস্তানের তুলনায় ৭৫ শতাংশ গরিব ছিল। কিন্তু এখন পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ ৪৫ শতাংশ বেশি ধনী। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১ কোটি বেশি ছিল। আর এখন পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৩ কোটি। যেখানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ।’

দুই দেশের অর্থনৈতিক পার্থক্য উল্লেখ করে প্রবন্ধে রিয়াজ নুর বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশের রফতানি আয় ৪৭ বিলিয়ন ডলার আর পাকিস্তানের মাত্র ২৮ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের ১ হাজার ৫৪৩ ডলারের তুলনায় বাংলাদেশে এখন মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলার। বাংলাদেশে ২০২২ সালে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৪১১ বিলিয়ন, পাকিস্তানে তা ৩৪৭ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশে বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ, পাকিস্তানে আগে যা ছিল ১২-১৫ শতাংশ। পাকিস্তানে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ২১ শতাংশ হয়েছে। ভবিষ্যতে এই হার আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া পাকিস্তানি রুপির তুলনায় বাংলাদেশি টাকা অনেক শক্তিশালী। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অধিক হারে অংশগ্রহণের পাশাপাশি সাক্ষরতার হার অনেক বেশি।

প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানের পিছিয়ে পড়ার জন্য পাক রাজনীতি ও রাজনীতিকদের দোষারোপ করেছেন রিয়াজ নুর। তিনি বলেন, পাকিস্তানে রাজনৈতিক দলগুলো এখনও নিজস্ব স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বারবার কারসাজির ফলে শক্তিশালী, গণতান্ত্রিক এবং পরিবারতন্ত্রবহির্ভূত রাস্তায় রাজনৈতিক দলগুলোর পথচলা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

তার ভাষায়, ‘এটা অনস্বীকার্য যে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, শক্তিশালী বেসামরিক প্রতিষ্ঠান এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। পাকিস্তান উত্তরাধিকার সূত্রে একটি রাষ্ট্র পেয়েছে, যেখানে শক্ত রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে একটি দুর্বল বুর্জোয়া জনগোষ্ঠী গ্রহীতা-দাতার সম্পর্কে বিন্যস্ত।
রিয়াজ নুর বলেন, ‘পাকিস্তান অনিবার্যভাবে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ও কর্তৃত্বমূলক গোষ্ঠীর মাধ্যমে পরিচালিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। প্রাথমিকভাবে কৃষি এবং ব্যবসায়িক আয়কে করের আওতা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।’

‘প্রচুর শিল্পকারখানা যেকোনো ধরনের শুল্ক থেকে অব্যাহতি প্রাপ্ত। আমাদের পার্লামেন্টে আধিপত্য ভূস্বামীদের, ফলে কৃষি আয়করের বিষয়টিকে নাকচ করে দেয়ার বিষয়টি আশ্চর্যজনক নয়। তবে এর ফলে কৃষি ও শিল্পখাতে কম করের কারণে সামগ্রিক করের আওতা ছোটই থেকে গেছে।’

পাকিস্তানি রাজনীতিকদের বাংলাদেশের নেতৃত্বকে অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়ে রিয়াজ নুর বলেন, বাংলাদেশের উদাহরণ অনুসরণ করে পাকিস্তানি নেতৃত্বকে অবশ্যই জাতীয় লক্ষ্য হিসেবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথ অনুসরণ করতে হবে এবং আঞ্চলিক শান্তির পাশাপাশি সাংবিধানিক শাসনকে এগিয়ে নিতে হবে।

এসএইচ-১৭/০৩/২২ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)