জর্জ চ্যাপেলে সমাহিত হলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ

উইন্ডসর ক্যাসেলের সেইন্ট জর্জ চ্যাপেলে সমাহিত হলেন ব্রিটেনের সদ্যপ্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সোমবার স্থানীয় সময় বিকেলে তার মরদেহ সেইন্ট জর্জ চ্যাপেলের রাজকীয় ভল্টে সমাহিত করা হয় বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

সাত দশকেরও বেশি সময় ব্রিটিশ সিংহাসনে আসীন থাকার পর গত ৮ সেপ্টম্বরে ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এরপর গত বুধবার থেকে ওয়েস্টমিনস্টার হলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শায়িত ছিল রানির কফিন। সেই দিন থেকে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মানুষ রানির কফিনে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

গত বুধবার থেকে বহু মানুষ প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যেও রাস্তায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রানিকে। তবে দেশটির স্থানীয় সময় সোমবার সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ছিল ওয়েস্টমিনস্টার হলে রানির কফিনে শ্রদ্ধা জানানোর সময় শেষ হয়।

এরপর ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে নিয়ে যাওয়া হয় রানির কফিন। বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতা, রাজপরিবারের অতিথি ও শত শত মানুষের অনুষ্ঠিত হয় রানির বিদায় অনুষ্ঠান।

ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে ধর্মীয় নেতারা রানির প্রতি শ্রদ্ধা, তার অবদান, প্রার্থনা জানিয়েছেন।ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে দুই মিনিট নীরবতা (দেশব্যাপী) পালন করা হয়। এরপর সেখানে গড সেভ দি কিং বাজানো হয় তখন রাজাকে কান্নাজড়িত অবস্থায় দেখা গেছে।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্যের আয়োজনে ঠিকরে পড়ে ব্রিটিশরাজের আভিজাত্য আর গাম্ভীর্য। শেষযাত্রাও তবে এত মোহময়, এত স্বাপ্নিক, এত মনোমুগ্ধকর হয়! এমন রাজসিক বিদায়ে মানায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত শেষের কবিতার বইয়ের শেষ কবিতার দুটি লাইন :

‘মোর লাগি করিয়ো না শোক, আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।’ শোক আয়োজনের প্রতিটি পদক্ষেপে যেন লুকিয়ে ছিল সংগীত। রাজকীয় সৈনিকের পায়ে পায়ে বাজে বিউগলের করুণ সুর। কখন বাজবে বিষণ্ন বাঁশি, কখন আসবে শবযাত্রার গাড়ি, কফিনের পেছনে কে কত ইঞ্চি দূরে দাঁড়াবেন, কতটা মেপে মেপে ফেলা হবে পা, বিষাদে কখন নত হবে পতাকা, সবকিছু চুলচেরা সময়ে বাঁধা। এমন পিনপতন নীরবতা, এমন নিশ্ছিদ্র, নিখুঁত, বিরল পরিবেশনা বিশ্ব দেখল অবাক নয়নে।

ব্রিটিশরাজের সূর্য অনেক স্থানে অস্ত গেছে। তবু এর আলো আজও এসে চোখে লাগল।
কী দোর্দণ্ড প্রতাপে তিনি বেঁচেছিলেন ৯৬ বছর! কী অসাধারণ দক্ষতায় সামলেছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ৭০ বছর! তিনি ছিলেন সারা পৃথিবীর কাছে রানি, ছিলেন আভিজাত্যের প্রতীক। তিনি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তাঁকে শেষবিদায় জানিয়েছে সারা পৃথিবী!

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কর্মেই এ বিশ্ব তাঁর জন্য মাতম করেছে গত ১১ দিন! টিভির পর্দায় বিশ্বের ৪১০ কোটি মানুষকে সাক্ষী রেখে রাজসিক বিদায় নিলেন তিনি। ১৯ সেপ্টেম্বর সোমবার যুক্তরাজ্য সময় সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে তিনি শায়িত হলেন উইন্ডসর প্যালেসের সেন্ট জর্জ চ্যাপেলের রয়েল ভল্টে।

৬ সেপ্টেম্বর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রথা ভেঙে বালমোরাল প্রাসাদেই নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে সরকার গঠনের অনুমতি দেন। সেদিনও রানি হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। ছবিতে দেখা গেছে রানি বয়সের ভারে ন্যুব্জ, তবু হাসছিলেন! এর ঠিক দুই দিন পরই ব্রিটিশদের প্রিয় লিলিবেট রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ চলে গেলেন। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, তারিখটি ব্রিটিশ ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে গেল। এমন একজন মানুষের জন্য স্থায়ী হলো, যিনি নিজেই ইতিহাস, যাকে ঘিরে বাঁক ধরেছে ইতিহাসের! ইতিহাসের অলিগলি তৈরি হয়েছে তাঁকে ঘিরেই।

এরপর ১১ দিন ধরে এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড শুধু প্রস্তুতি নিয়েছে তাঁকে বিদায় জানাতে। নতুন রাজার অভিষেক হয়েছে বেদনার মধ্য দিয়ে। গত ১১ দিনে ব্রিটেনে যা হয়েছে, রানিকে শেষবিদায় জানাতে সারা পৃথিবী থেকে জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষ যে আবেগ দেখিয়েছে, তা অনন্য! যে-কোনো শাসকের জন্য এটি কাক্সিক্ষত হলেও পেয়েছেন শুধু একজনই- রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। রাজা তৃতীয় চার্লস ১৮ সেপ্টেম্বর এক বক্তব্যে সারা বিশ্বের মানুষের প্রতি জানিয়েছেন কৃতজ্ঞতা। তিনি বলেছেন, তিনি অভিভূত এত ভালোবাসা, এত আবেগ দেখে!

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৭০ বছরের সাম্রাজ্য পরিচালনায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন কমেছে শুধু! কিন্তু তিনি সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করেছেন আরও বেশি! বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ শুধু ব্রিটেনের রানি ছিলেন তা-ই নয়, তিনি ছিলেন পুরো পৃথিবীর রানি, তাঁকে দেখলে মায়ের মতো মনে হতো!

রানিকে বিদায় জানাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, রাষ্ট্রীয় অতিথি, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা একই কথা বলেছেন। রানির রাজসিক বিদায়ে কাঁদছে সারা পৃথিবী। তিনি পেয়েছেন এমন এক ভালোবাসা, যা পৃথিবীতে বিরল, যাঁকে ধরা যায়নি, ছোঁয়া যায়নি, তাঁর জন্য অজানা দেশে বসে অজানা এক মানুষ দুই ফোঁটা চোখের জল ফেলছে, নীরবে প্রার্থনা করছে এমন নজির দেখেছে এ পৃথিবী।

শ্রদ্ধা, কুইন এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা ম্যারি?। মৃত্যু যেন অমরত্বের পেয়ালায় আয়েশে চুমুক…।

শেষকৃত্যানুষ্ঠানে সারা দিন যা হলো : সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এই দিনটি লেখা থাকবে বেদনাবিধুর দিন হিসেবে। ৮ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর, একের পর এক নজির স্থাপন করেছেন তিনি, লাখ লাখ মানুষ দিনরাত লাইন ধরে লাশে শেষশ্রদ্ধা জানিয়েছেন। কথা ছিল ভোর ৬টা পর্যন্ত লাশে শেষশ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পাবেন সবাই। তবে অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে তা বাতিল করা হয় পরশু ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টায়।

লন্ডন সময় সকাল ৮টায় খুলে দেওয়া হয় ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের মূল দরজা। সারা বিশ্বের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য আমন্ত্রিত ৫০০ অতিথিসহ ২ হাজার অতিথি আসা শুরু করেন ৮টায়ই।

এ ছাড়া সকাল থেকে লাখ লাখ লোক ভিড় জমিয়েছেন রানিকে শেষবিদায় জানানোর জন্য।

সকাল ১০টা ৪৪ মিনিটে লাশ ওয়েস্টমিনস্টার হল থেকে বের হয়ে যাত্রা করে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে পৌঁছায়। এ যাত্রার সম্মুখভাগে ছিল রয়্যাল নেভি। পেছনে ছিলেন রাজা তৃতীয় চার্লস, প্রিন্সেস অ্যান, প্রিন্স এন্ড্রু ও প্রিন্স এডওয়ার্ড। সঙ্গে ছিলেন প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারি। ১০টা ৫২ মিনিটে রানির লাশবাহী কফিন পৌঁছায় ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে।

এ সময় ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে আর্চবিশপ অব ক্যান্টাবারি জাস্টিন ওয়েলবাই যোগ দেন। কফিন রাখা হয় উঁচু বেদিতে। ঠিক ১১টায় শুরু হয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মূল পর্ব। এ পর্ব পরিচালনা করেন ওয়েস্টমিনস্টারের ডিন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস ও কমনওয়েলথ সেক্রেটারি প্যাট্রেসিয়া স্কটল্যান্ড বাইবেল থেকে পাঠ করেন। এরপর আর্চবিশপ অব ক্যান্টাবারি জাস্টিন ওয়েলবাই ধর্মের উপদেশবাণী পড়ে শোনান। ঠিক ১১টা ৫৫ মিনিটে শেষ হয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর্ব।

এরপর ৫ মিনিট মিউজিকের মধ্য দিয়ে সামরিক বাহিনী ও যুদ্ধকালীন রানির অংশগ্রহণ ও অবদান স্মরণ করা হয়। ঠিক ১২টায় ২ মিনিট নীরবতা পালন হয় সারা দেশে।

এর পরই বেজে ওঠে জাতীয় সংগীত। ওয়েলিংটন থেকে লাশ গাড়িতে তোলা হয়। ১২টা ১৫ মিনিটে লাশ যাত্রা করে উইন্ডসর ক্যাসেলের দিকে। তবে এটি বেলা ১টায় পৌঁছায় হাইড পার্ক কর্নারে। এ সময় রাজা তৃতীয় চার্লসসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা হাঁটেন কফিনের পেছনে। কফিনটি ওয়েলিংটন আর্চ হয়ে পার্লামেন্ট স্ট্রিট ধরে হোয়াইটহল, হর্স গার্ডেন, দ্য মল, কুইন্স গার্ডেন হয়ে আপসলে ওয়েতে যায়। এ যাত্রায় বিভিন্ন বাহিনী তোপধ্বনির মাধ্যমে রানিকে সম্মান জানায়। ওয়েলিংটন থেকে লাশ গাড়িতে তোলা হয়।

লাশ ঠিক বেলা ১টায় যাত্রা করে উইন্ডসর ক্যাসেলের দিকে। এ শেষযাত্রার আয়োজন সারা পৃথিবীতে লাইভ দেখেন ৪১০ কোটি মানুষ। এটি টেলিভিশনের সম্প্রচারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নেটওয়ার্কে সম্প্রচার।

বেলা ৩টা ৬ মিনিটে অন্তিমযাত্রা পৌঁছে যায় উইন্ডসর ক্যাসেলে। সেখান থেকে ঠিক ৩টা ৫৩ মিনিটে লাশবাহী কফিন পৌঁছায় সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে। সেখান থেকে লাশ নামিয়ে নেওয়া হয় চ্যাপেলের উত্তর অংশে।

উইন্ডসর ক্যাসেলের ডিন শেষপ্রার্থনা ও মৃতদেহের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন।

রানির লাশ নামানো হয় রয়্যাল ভল্টে। এরপর রানির সন্তান রাজা তৃতীয় চার্লসসহ পরিবারের সব সদস্যকে বের করে দেওয়া হয়। ঠিক সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে রানির লাশ ঢেকে দেওয়া হয় রয়্যাল ভল্টে।

এসএইচ-২৮/১৯/২২ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)