ঈদের জমায়েতে কী রাজনৈতিক বার্তা দিলেন মমতা ব্যানার্জী?

ভারতের কলকাতায় ঈদ উল ফিতরের সবচেয়ে বড় জমায়েতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, দেশে কিছু মানুষ ঘৃণার রাজনীতি ছড়িয়ে বিভাজন ঘটাতে চাইছে – আর তিনি সেই বিভাজন রুখতে প্রয়োজনে প্রাণও দিতে রাজী আছেন।

কলকাতার রেড রোডে পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে বড় যে ঈদের জমায়েতটি হয় শনিবার, সেখানে অন্যান্য বারের মতোই হাজির হয়ে মমতা ব্যানার্জী বলেন, “যারা দেশে বিভাজন সৃষ্টি করতে চাইছে, তাদের উদ্দেশ্যে এই ঈদের দিনে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, প্রাণ দিতেও আমি প্রস্তুত, কিন্তু দেশে বিভাজন ঘটাতে দেব না। আমরা দাঙ্গা চাই না, আমরা কোনও সংঘর্ষ চাই না। আমরা শান্তি চাই।”

তিনি আবারও বলেন যে তার রাজ্যে এনআরসি করতে দেওয়া হবে না।

কেউ কেউ আবার ‘বিজেপির কাছ থেকে অর্থ নিয়ে মুসলমান ভোট ভাগ করারও চেষ্টা করছেন’ বলেও অভিযোগ করেন মিজ ব্যানার্জী।

মমতা ব্যানার্জী বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে আমরা শান্তি চাই, কোনও দাঙ্গা চাই না। দেশে কোনও বিভাজন চাই না।”

তবে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি ‘ধর্মীয় উৎসবের মঞ্চকে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্য ব্যবহার করাকে’ কটাক্ষ করেছে ।

অন্যদিকে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজ্যের মুসলমানদের একটা অংশ ‘তৃণমূল কংগ্রেসের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে’, সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় এমন আভাস পেয়ে চিন্তায় পড়েছে মমতা ব্যানার্জীর দল। সেজন্যই ধর্মীয় উৎসবের মঞ্চ থেকে স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

মমতা ব্যানার্জী এনআরসির প্রসঙ্গও আনেন ঈদের জমায়েতে তার বক্তৃতায়।

তার কথায়, “যদি গণতন্ত্র ধ্বংস হয়, তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে। এখন সংবিধান বদলে দেওয়া হচ্ছে, ইতিহাস বদলে দেওয়া হচ্ছে। ওরা এনআরসি নিয়ে এসেছে। আমি বলে দিয়েছি এখানে এনআরসি করতে দেব না।“

কিছুদিন পরে রাজ্যের হাজার হাজার আসনে পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে আর আগামী বছর লোকসভার ভোট।

সেই প্রসঙ্গে মিজ ব্যানার্জী বলেন, “কিছু ব্যক্তি বিজেপির কাছ থেকে টাকা নিয়ে বলছে মুসলমান ভোট ভাগ করবে। আমি বলছি বিজেপির হয়ে মুসলমান ভোট ভাগ করার সাহস নেই তাদের। এটা আমার প্রতিশ্রুতি। নির্বাচনের এক বছর বাকি আছে, দেখা যাক কে জেতে।“

“একটা ধর্মীয় মঞ্চকে কীভাবে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করতে হয়, মমতা ব্যানার্জী আজ আবারও তার প্রমাণ দিলেন। তিনি এটা আগেও করেছেন,” বলছিলেন বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র কেয়া ঘোষ।

তার কথায়, “সংখ্যালঘু ভোট ফিরে পেতে তার মরিয়া হাবভাবটাই চোখে পড়ল আজকের ভাষণে। এটা দেখিয়ে দিল একজন রাজনৈতিক নেত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কীভাবে একটা বিশেষ সম্প্রদায়কে তোষণ করতে পারেন।“

মমতা ব্যানার্জী হঠাৎ করেই ঈদের জমায়েতে এনআরসির প্রসঙ্গ কেন আনলেন, সেই প্রশ্নও তুলছে বিজেপি।

মিজ ঘোষের কথায়, “এনআরসির কোনও প্রসঙ্গই তো আসে নি। কেন মুখ্যমন্ত্রী সেই কথা বললেন? উনি তো উস্কাচ্ছেন রাজ্যের মানুষকে। আর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ তো দেশের সংসদে পাশ হয়েছে, মমতা ব্যানার্জী কি তাহলে দেশের সংসদকেই চ্যালেঞ্জ করছেন?”

দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের সিংহভাগ ভোট তৃণমূল কংগ্রেস পায়, এমনটাই মনে করা হয়ে থাকে।

তবে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় মুসলমানদের একাংশ যে তৃণমূল কংগ্রেসের ওপরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বছর খানেক ধরেই সরকারের ওপরে মুসলমানদের একাংশের ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে, যার প্রথম বহি:প্রকাশ দেখা যায় সমাজকর্মী আনিস খানের মৃত্যুর সময়ে।

হাওড়া জেলার পুলিশ মি. খানকে মাঝরাতে গ্রেপ্তার করতে যায় এবং তিনি দোতলা থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান। তার আত্মীয় থেকে শুরু করে বিরোধী দলগুলি মনে করে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। ব্যাপক বিক্ষোভ হয় ওই ঘটনায়।

কয়েক মাস আগে মুসলমান প্রধান রাজনৈতিক দল আইএসএফের একমাত্র বিধায়ক ও ফুরফুরা শরিফের পীর পরিবারের সদস্য নওশাদ সিদ্দিকিকে ৪২ দিন জেলে আটক রাখা নিয়েও মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদীঘিতে উপনির্বাচনে দুবার জেতা আসনটি কংগ্রেসের কাছে খোয়াতে হয় তৃণমূল কংগ্রেসকে।

তখনই তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব টের পায় যে মুসলমানরা সম্ভবত একজোট হয়ে দলকে আর ভোট দিচ্ছেন না। মুসলমান প্রধান ওই আসনে এর আগে তৃণমূল কংগ্রেস প্রায় ২৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছিল, কিন্তু এবারে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান প্রায় ৫২ হাজার। তৃণমূল কংগ্রেসের দিক থেকে ৭৫ হাজারেরও বেশি ভোট সুইং হয়েছে, অর্থাৎ একদিক থেকে সরে বিরোধী দলের দিকে গেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্রর কথায়, “মমতা ব্যানার্জী ঈদের জমায়েত থেকে যা বলেছেন, সেগুলো যে তিনি প্রথমবার বলছেন, তা নয়। আগেও বলেছেন এইসব প্রসঙ্গ, পরেও হয়তো বলবেন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে তিনি ঈদের জমায়েতকে বেছে নিয়েছেন এই রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্য। মুসলমান ভোটকে বিভিন্ন সময়ে নানা রাজনৈতিক দল নিজেদের সম্পত্তি বলে মনে করে এসেছে।

“তৃণমূল কংগ্রেসও দাবী করত যে মুসলমানরা তাদেরই ভোট দেয়। কিন্তু সাগরদীঘি উপনির্বাচনে দেখা গেছে অন্যরকম ট্রেন্ড। সেই উদ্বেগেই সম্ভবত মমতা ব্যানার্জী ঈদের মঞ্চে এই কথাগুলো বলেছেন” – বলছিলেন মি. মৈত্র।

এসএইচ-১২/২২/২৩ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)