‘পিটিয়ে ভারত পাঠিয়ে দেয়ার’ হুমকি ইউএনওর

আশ্রয়ণ প্রকল্পে পানি নিষ্কাশনের জন্য নালা নির্মাণে বাধা দেয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদেরকে থাপ্পড় দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনসুর উদ্দিনের বিরুদ্ধে।

এ ঘটনায় করুণা কান্ত রায় নামে একজন লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

এতে বলা হয়, গত ১৭ জুলাই আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের কালীরহাট আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এ ১৬টি গৃহহীন পরিবারের জন্য মুজিব পল্লীতে বৃষ্টির পানি জমে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তাই প্রকল্পের পানি নিষ্কাশনের জন্য নালা নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দেয়।

ইউএনও মনসুর উদ্দিন ওই দিন নিজেই উপস্থিত থেকে করুণা কান্ত রায়ের জমির মাঝ দিয়ে নালা তৈরির কাজ শুরু করেন।

করুণা বাধা দিয়ে প্রশ্ন তোলেন কেন সরকারি খাস জমি থাকা সত্ত্বেও জোর করে তার জমি নেয়া হচ্ছে।

পরে তাদেরকে হুমকি ধমকি দেয়ার পাশাপাশি পুলিশও ডেকে আনেন ইউএনও। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ফিরে যায়।

এ বিষয়ে আদিতমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি সেখানে যাইনি। তবে সেখানে ইউএনও মহোদয়ের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হলে তিনি তাৎক্ষণিক মোবাইল কোর্ট আহ্বান করেন। পরে ঘটনাস্থলে আমার একটি টিম সেখানে যায়।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে ইউএনও মনসুর উদ্দিনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, ‘এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ পেয়েছি। তবে এখনও তদন্ত করা হয়নি। তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

কী অভিযোগ

করুণা কান্ত রায় বলেন, ‘আমার জমির মাঝ বরাবর দিয়ে ড্রেন না করে জমির এক পাশ দিয়ে ড্রেন নির্মাণ করেন তাতে আমার জমিটা ভালো থাকবে।’

এ সময় তার বড় ভাই অমূল্য কুমারও ইউএনওকে জমির এক পাশ দিয়ে নালা তৈরি করতে বলেন।

অভিযোগে বলা হয়, এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ইউএনও উত্তেজিত হয়ে করুণা ও তার দুই ভাই অমূল্য কুমার ও সুনীল কুমারকে গালাগাল করে বলেন, ‘আমি এই উপজেলার মালিক, আমি ইউএনও মনসুর উদ্দিন বলছি। আমি যে সিদ্ধান্ত দেব, সেটাই সবাইকে মেনে নিতে হবে।’

সিদ্ধান্ত মেনে না নিলে কী হবে সেটিও স্মরণ করিয়ে দেন ইউএনও। বলেন, ‘একেবারে থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফালায় দেব। এর পরেও যদি এখানে কেউ কথা বলার সাহস দেখায় তাহলে তাদের জমি খাস করে ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করে ভারতে পাঠিয়ে দেব এবং দরকার হলে ফেনসিডিল দিয়ে চালান দেব।’

তারা বলেন, এরপর ইউএনও আদিতমারী থানায় ফোন করে ঘটনাস্থলে পুলিশ নিয়ে আসেন। আর পুলিশ এসে পরিস্থিতি দেখে কাউকে কিছু না বলে ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়।

করুণা বলেন, ‘একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তার এ আচরণে আমরা মর্মাহত। একজন ইউএনও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কীভাবে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে পারেন আমার জানা নেই।

‘আমি লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। জেলা প্রশাসক মহোদয়ও ঘটনাস্থলে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো পদক্ষেপ নেন নাই।

‘আমার বাপ দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি দীর্ঘদিন হতে ভোগ দখল করে আসছি। তিনি (ইউএনও) খাস জমির উপর ড্রেন নির্মাণ না করে, যেখানে একশ গজ ড্রেন নির্মাণ করলে কাজ হবে, সেখানে উনি আমার জমিতে প্রায় পাঁচশ গজ ড্রেন নির্মাণ করার জন্য জেদ করে মাটি খুঁড়েছেন। এটি ওনি কীভাবে করতে পারেন?’

অমূল্য কুমার বলেন, ‘আমাদের জমির উপর দিয়ে ড্রেন নির্মাণ করা হলে আমাদের জমির ক্ষতি হবে। এতে আমার পুকুরের ক্ষতি হবে। তারপরও ড্রেন খোঁড়া শুরু করলে আমি বাধা দেই। তখন ইউএনও আমাদের গালাগাল করে বলেন, তিনি এই উপজেলার মালিক, তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই সবাইকে মেনে নিতে হবে। থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবেন।

‘এর পরেও যদি এখানে কেউ কথা বলার সাহস দেখায় তাহলে তাদের জমি খাস করে ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করে ভারতে পাঠিয়ে দেবেন এবং দরকার হলে ফেনসিডিল দিয়ে চালান দিবেন।’

অমূল্য বলেন, “ইউএনও মনছুর উদ্দিন আদিতমারী থানায় ফোন করে ঘটনাস্থলে পুলিশ নিয়ে আসেন এবং ‘আমিই সর্বেসর্বা, আমিই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’ এ রকম বলতে থাকেন।”

তিনি বলেন, “তখন আমার খুব মন খারাপ। আমার ছেলের বয়সের ছেলে হয়ে আমাকে চর থাপ্পড় দিতে চায়! বলে, ‘আমি ইচ্ছা করলে জমি খাস করে নিতে পারি। জমির মালিক আপনি? মালিক আমরাই’।”

পার্শ্ববর্তী আমেনা বেগম বলেন, ‘আমার জমি ভেঙে যায়। আমি ৫০ হাজার টাকা দিয়ে মাটি কেটে ভরাট করি। আর সেই জমি দিয়ে ইউএনও সাব আর কয়েকজন মানুষ রাস্তা কাটি দেয়।

‘তখন আমি বলি বাবা রাস্তা কাটি দিলে তো আমার জমি ভাঙি যাবে। আমি অনেক কষ্ট করি এ জমিটা কিনছি। এ জমিটার যদি রাস্তা কাটি দেন তাহলে আমার মতো বান্দার কোনো ক্ষমতা নাই। আমি তো এখন বয়স্ক হইছি।

“এ কথা শোনা সাথে সাথে ইউএনও সাব বলল, ‘তোমার গালে দিব চড়। আমাক চিনেন? আমি সরকারি কাপড় পড়ি নাই বলে আমাক চিনেন না?”

আমেনা বলেন, ‘তখন আমি বলি, আমাক যদি বিষও খিলান। আমি যাব না। কারণ জমিটা আমি অনেক কষ্ট করে কিনছি।’

পার্শ্ববর্তী জয়না বেগম বলেন, ‘একজন মায়ের বয়সী নারীকে কীভাবে ইউএনও চড় তুলতে পারে? জমিটা ব্যক্তি মালিকানা। পুকুরের মালিক তো করুণা ও অমলের। ইউএনও সাব জোর করি ড্রেন করছে।

“তখন ওরা নিষেধ করছে, তখন ইউএনও থাপ্পড় তুলছে। অনেক খারাপ ভাষা কইছে। বলে, ‘আমি আইনের লোক। আমি একাই সরকার। মন চাইলে তোমার বাড়ির উপর দিয়ে ড্রেন নিয়া যাব। তারপর মারিধরি ভারত পাঠে দিব’।”

‘ওনি আইনের লোক হলে একজন মুরুব্বিকে কীভাবে থাপ্পড় তুলতে পারে?’-প্রশ্ন রাখেন জয়না বেগম।

করুণা চন্দ্রের বড় ভাই সুনীল চন্দ্র বর্মন বলেন, “আমি ঘটনাস্থলে এসে শুনি, ড্রেন কাটার জন্য যখন বাধা দেয়া হয়েছে, তখন ইউএনও আমার ভাইকে থাপ্পড় তুলছে। বলে, ‘আমার মন খুশি যেখানে প্রয়োজন সেখান দিয়ে ড্রেন দিতে পারব। তুমি কে? প্রয়োজনে বাস্তভিটা দিয়ে ড্রেন করব। প্রয়োজনে ইন্ডিয়া পাটে দিবে। ফেনসিডিল দিয়ে মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিব’।”

এ বিষয়ে আদিতমারী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি সেখানে যাইনি। তবে সেখানে ইউএনও স্যারের সাথে বাগবিতণ্ডা হলে তিনি তাৎক্ষণিক মোবাইল টিমকে ডাকেন।

‘পরে ঘটনাস্থলে আমার একটি টিম পাঠাই। সেখানে এসআই ফরমান আলী যান এবং অপ্রীতিকর কিছু ঘটনার আগেই ওনাকে আদিতমারীতে নিয়ে আসেন।’

এসএইচ-২৫/০১/২১ (উত্তরাঞ্চল ডেস্ক, তথ্য সূত্র : নিউজবাংলা)