মন্ত্রীসহ পরিবারের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ৯ লাখ টাকা!

সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও লালমনিরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান আহমেদের বাড়ির বিদ্যুতের বিল মাসিক ৩২, ৫২, ৭২, ৬৫ টাকা করে দেখিয়েছে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)। আর মন্ত্রীসহ তাঁর ছেলে, ভাই ও প্রয়াত বাবা মিলে পুরো পরিবারের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ৯ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এসব বিল বকেয়া পড়েছে।

আইন অনুযায়ী বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায়ে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি নেসকো।

বুধবার মন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের লোকজনের কাছে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নেসকোর রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান। এরমধ্যে শুধু মন্ত্রীর নামে আবাসিক ও সেচ মিটারের বিপরীতে নেসকোর মোট বকেয়া বিলের পরিমাণ ৭২ হাজার ৯৬৪ টাকা দাঁড়িয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, তাঁর ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদ, ভাই শামসুজ্জামান ভুট্টু এবং প্রয়াত বাবা ও সাবেক সংসদ সদস্য করিম উদ্দিন আহমেদের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকার বিষয়টি নেসকোর ওয়েবসাইটে রয়েছে।

postpaid.nesco.gov.bd–এ ঢুকে imput consumer number দিয়ে অপরিশোধিত বিল অংশে গিয়ে এই চারজনের বিদ্যুতের বকেয়া বিলসংক্রান্ত তথ্য–উপাত্ত পাওয়া যায়। যা ঢাকা পোস্টের সংগ্রহে রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনে টানা দুইবার আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত করিম উদ্দিন আহমেদের ছেলে তিনি।

নেসকো থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের নামে কালীগঞ্জের কাশীরাম গ্রামে একটি মিটার রয়েছে। এটি সেচ সংযোগে ব্যবহার হয়ে আসছে। যার ডিজিটাল কনজুমার নম্বর ২৮০০৪৮৯৪; মিটার নম্বর ৫১৫৬২৫১৩। এ মিটারে প্রায় চার বছরে ৬১ হাজার ৩৪৪ টাকা বিদ্যুৎ বিল দেখানো হয়েছে। এখনো তা বকেয়া রয়েছে।

কাশীরাম গ্রামে ব্যবহৃত মিটারের বিপরীতে ২০২২ সালের মার্চ মাসের বিল ১৭ হাজার ২৩৬ টাকা, বিলম্ব ফি ৮৬২ টাকা; চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির বিল ৯ হাজার ৩৯০ টাকা, বিলম্ব ফি ৪৭০ টাকা; মার্চের বিল ৯ হাজার ৮৫০ টাকা, বিলম্ব ফি ৪৯৩ টাকা; এপ্রিলের বিল ৯ হাজার ৮৫০ টাকা, বিলম্ব ফি ৪৯৩ টাকা এবং মে মাসের বিল ৯ হাজার ৬৪০ টাকা ও বিলম্ব ফি ৪৮২ টাকা।

চলতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত গড়ে প্রতিমাসে সাড়ে ৯ হাজার টাকার বিল দেখানো হলেও জুন ও জুলাই মাসে শূন্য বিল দেখানো হয়েছে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে ১৭ হাজার ২৩৬ টাকা বিল দেখানো হলেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে শূন্য বিল দেখানো হয়েছে। গত বছর এপ্রিল মাস বিল দেখানো হয়েছে ৮০৪ টাকা এবং মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিমাসে বিল দেখানো হয়েছে ১৮০ টাকা।

মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের নামে আরও একটি আবাসিক সংযোগ রয়েছে। সেখানেও একই অবস্থা। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে বিদ্যুৎ বিল দেখানো হয়েছে ৩২ টাকা। এছাড়া কোনো মাসে ৭২ টাকা আবার কোনো মাসে ৫২ টাকা, ৬৫ টাকা, ১১১ টাকা বিল দেখানো হয়েছে। সর্বোচ্চ একটি বিল ২৪০৮ টাকা দেখানো হয়েছে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে। এ সংযোগেও গত প্রায় চার বছরে বিদ্যুৎ বিল দেখানো হয়েছে ১১ হাজার ৬২০ টাকা, যা এখনো বকেয়া রয়েছে।

এদিকে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর একমাত্র ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদ পেশায় কলেজশিক্ষক। তিনি লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদেও রয়েছেন। রাকিবুজ্জামান নেসকোর একজন আবাসিক গ্রাহক। তার বাড়িতে ব্যবহৃত মাসিক বিদ্যুৎ বিল দেখানো হয়েছে ৭২ টাকা, ১১১ টাকা, ১৫১ টাকা, ১৮৯ টাকা, ২২৯ টাকা ও ৫১২ টাকা। শুধু চলতি বছর জুলাই মাসে সর্বোচ্চ বিল ১৩ হাজার ৫৬১ টাকা প্রস্তুত করা হয়েছে। গেল প্রায় চার বছরে বিল দেখানো হয়েছে ৭৯ হাজার ৯৯৫ টাকা, যা পরিশোধ করা হয়নি।

এছাড়া মন্ত্রীর ছোট ভাই শামসুজ্জামান আহমেদ ভুট্টুর একটি বাণিজ্যিক সংযোগে গেল প্রায় চার বছরে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ ৬ লাখ ২০ হাজার ১১৩ টাকা। তার নামে একটি সেচ পাম্পের সংযোগও রয়েছে। গেল চার বছর ধরে বিল বকেয়া রয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ১১ টাকা। মন্ত্রীর বাবা প্রয়াত সংসদ সদস্য করিম উদ্দিন আহমেদের নামেও একটি আবাসিক সংযোগ রয়েছে। এ সংযোগটিও ব্যবহার করছেন তিনি। এ সংযোগে মাসিক বিল দেখানো হয়েছে ৬৩ টাকা, ১৭২ টাকা, ২৯৪ টাকা, ২৮০ টাকা। সর্বোচ্চ বিল ৪৯৬ টাকা দেখানো হয়েছে ২০২২ সালের আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে। গেল চার বছরে বিল দেখানো হয়েছে ১৮ হাজার ৫৭৭ টাকা। এখনো বকয়ো রয়েছে এসব বিল।

মন্ত্রীর ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদ বুধবার জানান, বিদ্যুৎ বিল বকেয়া আছে কি না তিনি তা জানেন না। বিদ্যুৎ বিলের বিষয়টি ব্যবস্থাপক দেখাশোনা করেন। তবে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের টাকা দেওয়ার কথা। সেটা দেওয়া হয়েছে কি না সেটা ব্যবস্থাপক ভালো বলতে পারবেন।

জানা গেছে, ‌মন্ত্রীর ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদের ডাকে দেখা করতে না যাওয়ায় গত ২৯ আগস্ট দুপুরে কালীগঞ্জে উপজেলা নেসকোর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী রকি চন্দ্র রায়সহ (৪০) কয়েকজনকে লাঞ্ছিত করা হয়। কার্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। হামলায় নেতৃত্ব দেন কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম। পরে লাঞ্ছিত প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করে নেসকো।

এদিকে ২০১৮ সালের বিদ্যুৎ আইনের ১৮ ধারায় এমন ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই ধারায় বলা আছে, কোনো গ্রাহক বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে ব্যর্থ হলে অথবা কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে, নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে ওই গ্রাহকের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে।

রংপুর নেসকোর নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান বলেন, যদি বিদ্যুৎ–সংযোগগুলো বকেয়া বিল থাকার পরও চলমান থাকে এবং নিয়মিত বিল করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে এসব বিদ্যুৎ–সংযোগের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। তবে বকেয়া পরিশোধ করতে মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিল প্রস্তুত করতে কোনো গাফিলতি করা হয়েছে কি না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

অন্যদিকে নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকিউল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ বিল প্রস্তুত করতে কোনো অসঙ্গতি হয়েছে কি না খতিয়ে দেখা হবে। এজন্য আগামী সপ্তাহে আমি নিজেই কালীগঞ্জ অফিস পরিদর্শনে যাব। অনিয়ম হলে অবশ্যই বিদ্যুৎ আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসএইচ-০৯/০৭/২৩ (উত্তরাঞ্চল ডেস্ক)