কোনো অভিযোগ নেই, আপনারা চলে যান: নিহত জেসমিনের ভাই

নওগাঁয় র‌্যাবের হাতে আটকের পর মৃত্যু হওয়া সেই সুলতানা জেসমিনের (৪৫) বাড়িতে এখন সুনসান নীরবতা। জেসমিনের মৃত্যুর বিষয়ে পরিবারের কেউ মুখ খুলছেন না। ঘটনার পর থেকেই নওগাঁসহ দেশজুড়ে চলছে নানা আলোচনা–সমালোচনা। গত শুক্রবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জেসমিনের মৃত্যু হয়।

সম্প্রতি নিহত সুলতানা জেসমিনের ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকত সাংবাদিকদের কাছে দাবি করে বলেছেন, ‘আমার মা চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। র‍্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে, যার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’

সরেজমিন গতকাল সোমবার দুপুরে নওগাঁ শহরের জনকল্যাণপাড়া এলাকায় সুলতানা জেসমিনের ভাড়া বাসায় গিয়ে তাঁর পরিবারের কাউকে না পেয়ে মামা সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হোসেন মন্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জেসমিনের সেই ভাড়া বাসায় এখন আর কেউ নেই। ছেলে সৈকত ও তাঁর মামা সোহাগ হোসেন জেসমিনের বাবার বাড়ি শহরের খাস নওগাঁ এলাকায় আছেন।

এরপর খাস নওগাঁ এলাকায় জেসমিনের বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। দীর্ঘক্ষণ ডাকাডাকির পর এক নারী জানালার পাশে থেকে সাড়া দেন। কিন্তু ওই নারী কোনো তথ্য দেননি। তাঁর পরিচয়ও তিনি দেননি প্রতিবেদককে। তবে জানিয়েছেন, বাড়িতে জেসমিনের ভাই সোহাগ হোসেন আছেন। উনি কারও সঙ্গে কথা বলবেন না।

এরপর আবারও জেসমিনের মামা নাজমুল হোসেন মন্টুর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সৈকত তাঁর মামা সোহাগ হোসেনের সঙ্গেই আছেন। মায়ের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন সৈকত। একটু পরপর জ্ঞান হারাচ্ছেন। অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব মাঝে মাঝে তাঁদের দেখতে আসছেন। সৈকতের কথা বলার মতো অবস্থা নেই। আর সৈকতের মামা সোহাগ হোসেন এ বিষয়ে আর কারও সঙ্গে কথা বলছেন না।

সৈকতের মামা সোহাগ হোসেন কোনো বিষয়ে আতঙ্কিত কি না, প্রশ্ন করলে মন্টু জানান, হতে পারে উনি আতঙ্কিত। কারণ অনেকেই তাঁকে ফোন দিচ্ছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিউজ হচ্ছে। এসব ব্যাপারই হয়তো আতঙ্কিত রয়েছে।

এ ঘটনার কোনো হালনাগাদ তথ্য আছে আপনার কাছে—এমন প্রশ্ন করলে নাজমুল হোসেন বলেন, ‘আপাতত কোনো আপডেট নেই। ময়নাতদন্তের রিপোর্টও আমি পাইনি এখনো। এসব বিষয়ে আর কিছু জানা নেই।’

নিহত সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে একটি আইসিটি মামলার কথা শোনা যাচ্ছে, এ বিষয়ে কিছু জানেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে নাজমুল হোসেন বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না।’

এরপর জেসমিনের বাবার বাড়ির কাছে অপেক্ষা করতে থাকলে গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাসা থেকে বের হন তাঁর ভাই সোহাগ হোসেন। এ সময় তাঁকে প্রশ্ন করা হয়—জেসমিনের ছেলে সৈকত কোথায়? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি কিচ্ছু জানি না। কে কোথায় আছে কিছুই জানি না। এসব বিষয়ে কোনো কথা নেই। সুলতানার মৃত্যু নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। আপনারা চলে যান।’

আপনি কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো বিষয় নেই। আপনারা চলে যান। আমার কোনো অভিযোগ নেই এসব নিয়ে।’

মামলার বিষয়ে নওগাঁ সদর থানায় যোগাযোগ করা হলে ওসি ফয়সাল বিন আহসান বলেন, জেসমিনের বিরুদ্ধে নওগাঁ সদর থানায় কোনো অভিযোগ বা মামলা নেই। তবে রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় একটি মামলা হয়েছে।

এদিকে এ বিষয়ে নওগাঁর সহকারী কমিশনার (ভূমি) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সুলতানা জেসমিন এক বছর ধরে আমার অধীনে কাজ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ শুনিনি। র‍্যাব যেদিন তাঁকে আটক করেছে, সেটিও প্রথমে জানতে পারিনি। পরে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে খবর পেয়েছি।’

গত ২২ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় থেকে প্রতারণার অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয় বলে র‍্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এরপর মস্তিষ্কে গুরুতর রক্তক্ষরণে অসুস্থ হয়ে ২৪ মার্চ সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন বলে র‍্যাব দাবি করে। তবে স্বজনদের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতনের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। দায়িত্বরত চিকিৎসক সুলতান জেসমিনের মাথাজুড়ে একাধিক ইন্ট্রাক্রানিয়াল রক্তক্ষরণ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এফ এম শামীম আহাম্মদ সুলতানার মাথার বাইরের দিকে ক্ষত থাকার কথাও জানান।

পরে পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে বলা হয়েছে, তারা আটকের বিষয় সম্পর্কে অবগত ছিল না, বরং গণমাধ্যম থেকে তারা তথ্যটি জানতে পেরেছে। আরও জানা গেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে মামলায় জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে, সেই মামলা দায়ের করা হয়েছে তাঁকে আটকের প্রায় ৩১ ঘণ্টা পর ২৩ মার্চ বিকেলে এবং মামলাটি দায়ের করেছেন রাজশাহী বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার অফিসের পরিচালক এনামুল হক।

এসএ-৪/২৮/২৩ (জাতীয় ডেস্ক)