চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ অবস্থিত। পদ্মা নদীর উজানে ভারতের গঙ্গায় নির্মিত ব্যারাজটি প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের পদ্মাসহ এর শাখা নদ-নদীর গতিপথে এই বাঁধ বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
ভারতে ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি সরিয়ে নেওয়ার কারণে পাঁচ দশকে বাংলাদেশের পদ্মার অনেক অংশেই চর জেগেছে, শুকিয়ে মরে গেছে পদ্মার উৎস থেকে সৃষ্টি হওয়া বেশকিছু নদীও। এ নিয়ে অনেকবার বিতর্কের মুখে পড়েছে ভারত। টানাপোড়েন ঘটেছে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে। কিন্তু স্থায়ী সমাধান পায়নি বাংলাদেশ।
গত ৫০ বছরে ফারাক্কা ব্যারাজ বাংলাদেশের নদ-নদীতে যে বিরূপ প্রভাব রেখেছে তার বড় সাক্ষী পদ্মা পাড়ের মানুষ। ফারাক্কা পয়েন্টে ভারত পানি সরিয়ে নেওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় মারাত্মক পানি সংকট তৈরি হচ্ছে। এক সময়ের খরস্রোতা নদীতে চর জাগায় সংকীর্ণ হয়েছে এর গতিপথ।
তবে এর উল্টো চিত্রও রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কার সব গেট খুলে দেয়ার কারণে প্রায় প্রতিবছরই গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেখা দিচ্ছে বন্যা ও ভাঙনের সমস্যা।
ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মার অবস্থা
ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পদ্মা নদী। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এ নদীটি উত্তরবঙ্গে রাজশাহী বিভাগ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
নদী গবেষকরা বলছেন, দেশর দীর্ঘতম এ নদীর গতিপথ থেকে শুরু করে এর শাখা নদ-নদীর প্রবাহে মারাত্মক ক্ষতি করেছে ফারাক্কা। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেখা যায় ধুধু বালুচর।
রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন জানান, তাদের এক গবেষণায় তারা দেখেছেন উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগের সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মার ৮০ শতাংশ পানির প্রবাহ এখন কমে গেছে।
পদ্মা নদী-তীরবর্তী হাকিমপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ সানাউল্লা পদ্মা নদীকে দেখার ৭০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, আগে অনেক স্রোত ছিল, নদী বড় ছিল। এখন তো পুরো চর। বাঁধ যখন ছিল না তখন পানির খুব বেগ, ক্ষমতা আর স্রোত ছিল। এ নদীর একটা পাড়ে নৌকা ভেড়াতে চারজন লোকও ঘাবড়ে গেছে, কারণ পানির এত স্রোত ছিল। এখন তো শুধু ডাঙ্গা।
পানি কমে যাওয়ায় নদীতে হ্রাস পেয়েছে মাছের পরিমাণও। এ বিষয়ে একজন জেলে জানান, বর্ষা মৌসুমে কিছু মাছ ধরা পড়লেও বছরের অন্যান্য সময় বড় বড় মাছ এখন নদীতে মিলছে না। অনেকে মাছ ধরা পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
পদ্মার শাখা নদ-নদীর মৃত্যু
পানি প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্তের কারণে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে শুকিয়ে গেছে পদ্মার বেশ কিছু শাখা নদ-নদী। পানি সংকটের কারণে পদ্মার যে শাখা নদীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত তার একটি বড়াল। রাজশাহী থেকে ভাটিতে চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখ।
বড়ালের উৎসমুখে দেখা যায় বিশাল চর, সেখানে পানির প্রবাহ নেই। নদীটির দুই পাশে চর পড়ে উঁচু হয়ে গেছে। মাঝখানে সরু নালার মতো। পদ্মা থেকে রাজশাহী, নাটোর হয়ে বড়াল নদীর গতিপথ যমুনা পর্যন্ত বিস্তৃত।
পানি সংকটে পদ্মার যে শাখানদীগুলো সংকটে তার মধ্যে অন্যতম কুষ্টিয়ার গড়াই নদী। অর্ধশতাব্দির বেশি সময় পদ্মা আর গড়াই নদীতে মাছ ধরে জীবন-জীবিকা চলছে নায়েব আলীর। তার মতে, পদ্মার শাখা নদী গড়াইকে এখন জীবিত বলা চলে না। এই নদীতে আগের মত মাছ নেই। চর জেগেছে।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুর রহমান বলেন, গড়াই নদী হলো পদ্মার একমাত্র পানির উৎস। আর এই গড়াই নদী সুন্দরবন পর্যন্ত মিঠা পানির প্রধান সোর্স। শুধু এই নদীতে টোটাল ৪৪ কিলোমিটার চর পড়ে গিয়েছিল। বর্তমানে আমরা ড্রেজিং ও তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে এই নদী সচল রাখছি।
তিনি আরও বলেন, কুষ্টিয়াতে ১১টা নদী আছে। এই নদীগুলো পদ্মা ও গড়াই নদীর সঙ্গে যুক্ত। এখন যদি টোটালি পদ্মায় পানি না পাওয়া যায় তাহলে এই নদীগুলো মৃতপ্রায় হয়ে যাবে।
পদ্মার আরও বেশ কিছু শাখা নদী ফারাক্কার প্রভাবে মৃতপ্রায় বলে উল্লেখ করেন নদী নিয়ে কাজ করা রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন। তিনি বলেন, ‘কপোতাক্ষ, ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, কুমার এই সবগুলো নদী যেগুলো সুন্দরবনে পানিপ্রবাহ নিয়ে যায় এগুলো মরে গেছে। আপনি কপোতাক্ষ নদের কাছে গিয়ে দেখবেন কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও পানিই নেই। যে হাঁটু পানি দেখা যায় সেটি বৃষ্টির পানি।’
‘ভারতে জলাঙ্গী তারপর বাংলাদেশে মাথাভাঙ্গা, কুমার, নবগঙ্গা, গড়াই এবং চন্দনা–– এই সবগুলো নদী একসময় গঙ্গার মূল প্রবাহ ছিল। এই সবগুলো নদীই শাখানদীও টেকে নাই’, যুক্ত করেন তিনি।
চুক্তি ও সমাধান
রিভারাইন পিপলের শেখ রোকন পদ্মা ও এর শাখা নদনদীগুলোর বর্তমান সংকটের পেছনে ১৯৭৫ সালে চালু হওয়া ফারাক্কা ব্যারাজকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের গবেষণায় দেখেছি যে ফারাক্কা চালু হলো ১৯৭৫ সালে, তার আগ পর্যন্ত এই নদীগুলো ঠিক ছিল। যখন ফারাক্কা বাঁধ চালু হলো তারপর এই নদীগুলো মরে যাওয়া শুরু হয়েছে।’
ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা একটি চুক্তি করেছি ১৯৯৬ সালে। এই চুক্তি ২০২৬ সালে শেষ হবে। ওই চুক্তির পর আমরা কিছু পানি পেয়েছি। কিন্তু তার আগে ২০ বছরে যে পানি আসে নাই তখন এই নদীগুলো মরে গেছে।’
২০২৬ সালের ডিসেম্বরে গঙ্গা চুক্তি শেষ হয়ে যাবে। তাই পদ্মার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অবিলম্বে গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়নসহ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
তিনি জানান, আন্তর্জাতিকভাবে আন্তসীমান্ত নদীর জন্য দুটো সনদ আছে জাতিসংঘ থেকে। একটা হচ্ছে ইউএন ওয়াটার কনভেনশন ১৯৯২, আরেকটা হলো ইউএন ওয়াটার কোর্সেস কনভেনশন ১৯৯৭। এই দুটি বিষয় বাংলাদেশকে দ্রুত অনুমোদন করতে হবে।
এআর-০২/০২/০৫ (সূত্র: বিবিসি বাংলা)