বাঙালির ‘ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড’

ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড

ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড-এর গল্প যৌন-বিপ্লব ইত্যাদির তোয়াক্কা না রেখেই তার স্রোতে বয়ে চলেছে। এই গল্পে এসে মিশেছে বিদেশ, বিমান-বিভ্রাট, এমনকী হাইজ্যাক-আতঙ্কবাদী ইত্যাদিও।

(না। এ লেখা সানি লিওন-অধ্যুষিত সাম্প্রতিক ছায়াছবির সমালোচনা নয়। সন্দেহাতীতভাববে এ লেখাকে ট্রিগার করেছে ওই ছবির নাম। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আর কোনও ঋণ এই সামান্য মুসাবিদা সেই মহান ছবির কাছে রাখে না।)

১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছবি ‘একটি রাত’-এর কথা এই প্রজন্মের বঙ্গজদের মনে থাকার কথা নয়। উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত সেই ছবির বিষয় ছিল ‘ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড’। দূর মফস্‌সলের এক হোটেলে দুই অপরিচিত নরনারীর একটি রুমে আটকে পড়া এবং তৎপরবর্তী সমস্যা নিয়ে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত কমেডি ছিল সেই ছবি।

আর এই ছবির চিত্রনাট্যে মূল মোচড়টি ছিল এই— নায়ক, নায়িকা দু’জনেই বিবাহিত। সেই ‘একটি রাত’ যদি সাম্প্রতিক প্রজন্মের বাঙালির মেমরি-ব্যাংকে না-ও থাকে ক্ষতি নেই। একটু আগ বাড়িয়েই বলা যায়, এমন একটি রাতের কথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে বাঙালি এত বেশি ভেবেছে যে, তা কল্পনা না বাস্তব, সেই বোধটাই লুপ্ত হয়ে গিয়েছে।

‘ইট হ্যাপেনড ওয়ান নাইট’, ‘দিল হ্যায় কে মানতা নেহিঁ’ ইত্যাদি ইত্যাদি ভারতীয় ছবিও ঘুরে ফিরে সেই ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড-এর দিকেই ধাবিত করে ভারতীয় চৈতন্যকে। সেভাবে দেখলে মনে হতেই পারে, ভারতীয় জনজীবনে এই ‘একটি রাত’-এর একটা কালজয়ী অভাব রয়েছে।

আর সেই অভাবটাকে জিইয়ে রেখেই তৈরি হয় একের পরে এক ফ্যান্টাসি। রোম্যান্স আর রোমাঞ্চ একপাতে পরিবেশনের এই দায় বাঙালি নিজের কাঁধে নিতে কেবল সিনেমা নয়, একটা বড় সময়ের সাহিত্যও এই এক কাজে আত্মনিয়োগ করে। এখানে মনে রাখা দরকার, ‘ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড’ সব সময়ে ‘ওয়ান নাইট’-এর মামলা না-ও হতে পারে। তা গড়িয়ে সাতদিন-পনের দিন পর্যন্ত গড়াতে পারে।

মনে করুন কালকূটের সেই উপন্যাসগুলির কথা, তা সে ‘নির্জন সৈকতে’-ই হোক অথবা ‘আরব সাগরের জল লোনা’, অপরিচয়, রোম্যান্স, বিষাদ আর তীব্র প্যাশন ডমিনেট করেছে সেই সব রচনাকে। জানা নেই সাম্প্রতিক প্রজন্মের বাঙালি কালকূট সম্পর্কে কতটা আগ্রহী। কিন্তু একবার যাদি একটু রিস্ক নিয়ে তাঁরা প্রবেশ করেন, কোনও অর্থেই ঠকবেন না, নিশ্চিত।

বাঙালির ফ্যান্টাসির গোড়াতেই কি ‘ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড’ ক্রিয়া করছে না? ভাবুন, শীর্ষন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘দিন যায়’। নায়ক মনোরম নায়িকা সীতাকে তাদের প্রণয়পর্বের গোড়াতেই শুনিয়েছিল তার ফ্যান্টাসিগুলির গল্প। সেখানে বার বার এসেছে অপরিচিত নারী আর আর পরে বয়ে যাওয়া স্বগতোক্তির স্রোত।

অপরিচয়ের আবছায়া আর ক্রমাগত শেড বদলে ফেলা পার্সপেক্টিভ-কে মনোরম শেষ পর্যন্ত গুটিয়ে এনে ফেলেছিল সীতার পায়ের কাছে। যাদি না আনত? যদি সেই কল্পনার স্রোত বয়ে যেত স্ট্রিম অফ কনশাসনেস হয়ে অনন্তের দিকে….?

১৯৭০ আর ১৯৮০- দশকের সেই মুঠ্‌ঠি-ভর বাঙালি পরিসর আজ আর নেই। থাকার কথাও নয়। কিন্তু ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড-এর গল্প যৌন-বিপ্লব ইত্যাদির তোয়াক্কা না রেখেই তার স্রোতে বয়ে চলেছে।

এই গল্পে এসে মিশেছে বিদেশ, বিমান-বিভ্রাট, এমনকী হাইজ্যাক-আতঙ্কবাদী ইত্যাদিও। কিন্তু এর বেসিক জায়গা— একটি হোটেল-রুম, দুটি অপরিচিত নরনারী আর তাদের না-নিবিড় রোম্যান্সকে কোনও গ্লোবালাইজেশনই বদলাতে পারেনি।

বদলানোর দরকারটাই বা কী? একবার ফির আজনবি বন যায়ে হম দোনো। যাবতীয় পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা আর সামাজিকতাকে ছুড়ে ফেলে অনির্দেশ্য বৃথাভ্রমণে আটকে পড়ি কোনও হোটেলের ঘরে। তার পরে খুলে যাক আগল। না। সব সময়ে যৌনতার নয়।

বাঙালি সব খুইয়েও সেই শিভ্যালরিকে বজায় রেখেছে বলেই বিশ্বাস। খুলে যাক এমন কিছু সংবেদের অভিমুখ, যা সোশ্যাল মিডিয়া দিতে পারে না। দেওয়ার ক্ষমতাই নেই তাদের। সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে না-পারলেও মনে মনে বাঙালি জানে। আর জানে বলেই তার ফ্যান্টাসিতে বার বার উঠে আসে ‘ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড’— অপরিচয়, আবছায়া আর অনির্দেশ্য সম্পর্কের ধুপছায়া।

জমা হয় মনোলগ। একা। নিভৃতে। কেবলমাত্র ‘একটি রাত’-এর অপেক্ষায়।

আরএম-২০/১৬/০২ (লাইফস্টাইল ডেস্ক, সূত্র: এবেলা)