কী কারণে সূর্যের দিকেই মুখ করে থাকে সূর্যমুখী?

তিদিন ভোরবেলায় যখন পূবাকাশে সূর্যোদয় হয়, তখন সূর্যমুখী ফুল পূর্বদিকে মুখ করে থাকে। ধীরে ধীরে সূর্য উপরের দিকে উঠতে থাকে। সূর্যের সাথে সাথে ধীরে ধীরে নিজের দিক পাল্টাতে থাকে সূর্যমুখীও।

সূর্য যখন পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যায়, তারাও তখন পশ্চিম দিক বরাবর থাকে। সূর্যাস্তের পর সারা রাত ধরে উল্টো দিকে ঘুরে আবার পূর্বমুখী হয় এই ফুল।

এভাবে বৃদ্ধ হবার আগ পর্যন্ত তাদের এই চক্র অব্যাহত থাকে। কিন্তু ঠিক কী কারণে সূর্যের দিকেই মুখ করে থাকে সূর্যমুখী? অনেকদিন ধরে বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন।

এতদিন কোনও সন্তোষজনক উত্তর না পেলেও সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের একটি দল সূর্যমুখীর এই দিক পরিবর্তনের রহস্যভেদ করেছেন। ‘সায়েন্স’ জার্নালে গবেষকরা এর বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন।

গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে, সূর্যমুখীরা তাদের নিজস্ব সার্কাডিয়ান চক্রে আবদ্ধ। এই চক্র সচল থাকার কারণে সূর্যমুখীরা সবসময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে।

সার্কাডিয়ান চক্র বা সার্কাডিয়ান ক্লক-কে অনেক সময় ‘দেহ ঘড়ি’ নামেও ডাকা হয়। মানুষের মাঝেও এই চক্র বিদ্যমান। উদ্ভিদের মাঝে সাধারণত এই চক্রের উপস্থিতি থাকে না। খুব অল্প সংখ্যক ব্যতিক্রমের মাঝে একটি হচ্ছে সূর্যমুখী। এই চক্রকে ব্যবহার করে সূর্যমুখী ফুল সবসময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে।

সূর্যের দিকে মুখ করে থাকলে সূর্যমুখী ফুল আকারে বড় হয় এবং পরাগায়নের জন্য মৌমাছিকে আকৃষ্ট করতে সাহায্য করে। এই বৈশিষ্ট্য সূর্যমুখীকে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। যে ফুল আকৃতিতে বড় হবে এবং পরাগায়নের জন্য অধিক পরিমাণ মৌমাছি পাবে সেই ফুলের বীজ হওয়া বা টিকে থাকার সম্ভাবনা অবশ্যই বেশি।

সূর্যমুখীদের এই বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। প্রথমে তারা গাছকে কাঠির সাথে আটকে রাখেন যেন নড়াচড়া করতে না পারে।

পাশাপাশি গাছ যে সময় পূর্বদিকে মুখ করে থাকার কথা ওই সময় জোর করে গাছকে পশ্চিমমুখী করে দেন। এতে দেখা যায় গাছেরা এই পরিবর্তনকে কাটিয়ে উঠতে পারে এবং আবারো চক্রে ফিরে যেতে পারে।

তারপর তারা সূর্যমুখী গাছগুলোকে ঘরের ছায়ায় নিয়ে আসেন। এখানে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা কোনও বিরতি ছাড়াই কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করেন। সূর্যমুখীর কাছে সূর্যের বিরামহীন অবস্থা উপস্থাপন করা হয়।

এতেও দেখা যায় গাছেরা আগের মতোই চক্রাকার দোলায় দুলছে। গবেষক বিজ্ঞানীরাও এদের কাছে এমন আচরণই আশা করছিলেন।

এরপর তারা কৃত্রিমভাবে দিন-রাতের চক্রের সৃষ্টি করলেন। পূর্ব দিক থেকে আলোকের উদয় হয় এবং নিয়ম মেনেই ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে অস্ত যায়।

এই চক্র যখন সূর্যের চক্রের অনুরূপ ছিল অর্থাৎ প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার করে চক্র সম্পন্ন হয় তখন পর্যন্ত সূর্যমুখীরা তাল মিলিয়ে চলতে পেরেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা চক্রের মাঝে কিছু পরিবর্তন আনেন। ২৪ ঘণ্টার বদলে চক্র নিয়ে যান ৩০ ঘণ্টায়।

যখন থেকে চক্র পালটে ৩০ এ চলে গেল তখন থেকে সূর্যমুখীদের মানিয়ে নিতে সমস্যা হতে লাগলো। তাদের আভ্যন্তরীণ সার্কাডিয়ান ঘড়িতে বিঘ্ন শুরু হলো।

একইসাথে সূর্যকে অনুসরণ করা এবং আভ্যন্তরীণ ঘড়ি মিলিয়ে চলা সম্ভব হয়ে ওঠে না এদের বেলায়। তাই ৩০ ঘণ্টার চক্রে এরা তালগোল পাকিয়ে ফেলে। হয় ২৪ ঘণ্টার চক্রে সূর্যের আলো দাও নয় সারাদিনই দাও, এতে সমস্যা নেই, গাছেরা মানিয়ে নিতে পারবে।

কিন্তু বিভ্রান্তিমূলকভাবে ৩০ ঘণ্টা বা তার থেকে বেশি সময়ব্যাপী চক্র উপস্থাপন করলে তাতে খাপ খাইয়ে নিতে সমস্যা হবে। মানুষের বেলায়ও এরকম হয়।

কেউ যদি রাতের বেলায় সবসময় লাইট জ্বালিয়ে রাখে তাহলে তার চক্র ২৪ ঘণ্টায় সম্পন্ন না হয়ে ধীরে ধীরে ২৫ ঘণ্টায় আবর্তিত হয়। আজ ১১ টায় ঘুমালে আগামীকাল ১২ টায় ঘুমাবে। পরের দিন ১ টায়। এরকম করে এগোবে।

তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, চক্র হোক আর যাই হোক, ঠিক কোন কার্যপ্রণালীর উপস্থিতির কারণে গাছের এমন পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়?

গবেষকরা দেখতে পান এর পেছনে দায়ী আছে সূর্যমুখীর একপেশে বৃদ্ধি। একপেশে বলতে বোঝানো হচ্ছে গাছের কাণ্ডের এক দিক অন্য দিকের চেয়ে বেশি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। দিনের বেলা কাণ্ডের পূর্ব পাশে তুলনামূলকভাবে বেশি বিভাজন হয়, ফলে বেশি বৃদ্ধি হয়।

দুই দিকে একটা তারতম্যের সৃষ্টি হয় এবং এতে করে কাণ্ড পূর্বদিক থেকে ধীরে ধীরে পশ্চিমমুখী হয়। সন্ধ্যার পর থেকে আবার এই চক্র উল্টোভাবে সম্পন্ন হয়।

কাণ্ডের পশ্চিম পাশের অংশ পূর্বপাশের তুলনায় বেশি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ফলে ধীরে ধীরে কাণ্ড পূর্বমুখী হয়ে যায়। ভোর হওয়ার আগেই এই চক্র সম্পন্ন হয়ে যায় এবং সূর্য ওঠার সাথে সাথে নতুন আরেকটি চক্রের শুরু হয়।

এই চক্রের উপস্থিতির কারণে এরা কিছুটা সুবিধা পায়। গবেষকরা দেখেছেন যেসব ফুলকে ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রাখা হয় বা চক্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয় তারা স্বাভাবিকের চেয়ে শতকরা ১০ ভাগ ছোট হয়ে থাকে।

শুধু সূর্যমুখীই না, উল্লেখ করার মতো প্রায় সকল উদ্ভিদই সূর্যের দিকে মুখ করে থাকতে চায়। সূর্যের দিকে মুখ করে থাকার ফলে সকল উদ্ভিদই লাভবান হয়।

হয়তো সূর্যমুখীর মতো প্রতিদিন দিক পাল্টায় না কিন্তু সবসময়ই সূর্যের দিকে মুখ করে থাকতে চায়। উদ্ভিদের এই বৈশিষ্ট্যকে বলে আলোকমুখিতা। উদ্ভিদ সূর্যের আলোর মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও পানি ব্যবহার করে নিজেদের খাদ্য তৈরি করে।

তবে অন্যান্য উদ্ভিদগুলোতে সার্কাডিয়ান চক্র না থাকাতে সূর্যমুখীর মতো এরা দিন-রাতে নিজেদের অবস্থান পাল্টাতে পারে না।

আরএম-০৭/১৯/০৩ (লাইফস্টাইল ডেস্ক)