বিয়ের পর কেমন হয় নববধূর অভিজ্ঞতা

বিয়ের পর

রংপুরের পীরগাছায় এক কিশোরী নববধূকে বিয়ের সাত দিনের মাথায় স্বামী ও তার পরিবার যৌতুকের দাবিতে হাত ও পায়ের রগ কেটে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বলা হচ্ছে, ১৯ বছর বয়সী এই নারীকে শনিবার ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হাত ও পায়ের রগ কেটে, তারপর স্থানীয় ডাক্তার দিয়ে আঘাত সেলাই করে সারারাত আটকে রাখে শ্বশুর বাড়ির লোকজন।

তার বড় ভাই শফিকুল ইসলাম বলছেন, “পরদিন তাকে আনতে গেলে শুরুতে আমাদেরকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। তারপর আমরা পুলিশের কাছে যাই। তারা এসে তাকে উদ্ধার করে। ওর হাত আর পায়ে সব মিলিয়ে প্রায় ২০টার মতো সেলাই দিতে হয়েছে।”

পীরগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ রেজাউল করিম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তারা যখন উদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন তখন হাতে ও পায়ে সেলাই করা অবস্থায় মেয়েটিকে পাওয়া গেছে।

এই ঘটনায় মামলা দায়ের করেছে মেয়েটির বাবা।

বাংলাদেশে বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন নারীরা। কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন একটি জায়গায় ও অপরিচিত পরিবারে একজন নববধূকে বেশ নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে পরতে হয়।

দুজন নববধূর অভিজ্ঞতা?

অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিয়ে হয়েছে সুমাইয়া আক্তারের। পটুয়াখালীর সুবিদখালির এই কিশোরী স্বামীর চেহারাও এখনো দেখেননি কারণ বিয়ের অনুষ্ঠান সেরেই ঢাকায় চলে গেছেন তিনি।

সুমাইয়া বলছেন, স্বামীর পরিবারের সাথে মানিয়ে নিতে তাকে নানা রকম শিক্ষা দীক্ষা দিচ্ছেন তার পরিবারের গুরুজনেরা।

“আমাকে সবার মন রাখতে বলেছে। সবার মতো চলতে বলেছে। সবকিছু করলেই সামনে ভালো হবে।”

কিছুটা শঙ্কা নিয়ে নতুন জীবনের জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। তাকে সবাই পছন্দ করবে তো? আপন করে নেবে কিনা, তার চেহারা বা রান্না পছন্দ হবে তো?

শেরপুরের চাননগর এলাকার ১৯ বছর বয়সী রাশিদা এরকম আরেকজন। তিনি বলছেন, “প্রথম গিয়ে মনে হল ভালো। সবাই বলল ভালো। কিন্তু পরে দেখি তারা স্বর্ণের জন্য লোভ করে।”

রাশিদার কথাগুলোর মধ্যে ছিল বড় বড় দীর্ঘশ্বাস। বলছিলেন মারধোর ছাড়াও নানা রকম কটূক্তিও ছিল নিয়মিত ব্যাপার।

তিনি বলছেন, “সবাই বলতো কী মেয়ে বিয়ে করে আনছে, ভাত রান্না করতে পারে না। তারা ফকফকা সাদা মেয়ে চায়। আমি বললাম তোমরা তো আমাকে দেখেই নিয়ে এসেছ। আমাকে বলে কালো আবার বেশি কথা বলো। কিছু বললে আরও মারত।”

রাশিদা আট মাসের মাথায় বাপের বাড়ি ফিরে এসেছেন। এখন ঢাকায় পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করেন।

কম বয়সে বিয়ে মেয়েদের নাজুক করে তোলে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইশরাত শামিম বলছেন, বাংলাদেশে সামাজিকভাবে নারীর অধস্তন অবস্থান, সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা না থাকা আর আর্থিক নির্ভরতা তাকে নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়।

তিনি বলছেন, বিশেষ করে কম বয়সে বিয়ের কারণে নববধূদের এমন কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়তে হয় যা সামাল দেয়ার ক্ষমতা তার তখনো হয়নি।

“বিয়েটা শুধু স্বামীর সাথে হয় না। বিয়েটা হচ্ছে একটা ফ্যামিলির সাথে। তাকে শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ, স্বামী অনেক মানুষকে সামলাতে হয়। কোন কাজটা করলে শ্বশুর-শাশুড়ি রেগে যাবে, স্বামী মারবে, কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিলে এসব ডাইনামিক ক্ষমতা তাদের থাকে না।”

মানসিক সমস্যায় পরেন অনেকে

হয়তো এভাবে শুরু করা বৈবাহিক জীবন মেনে নিয়ে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন তারা।

তবে ক্লিনিকাল সাইকোলজিষ্ট ড. ইশরাত শারমিন রহমান বলছেন, নববধূরা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হন যা কারো মনোযোগ পায় না।

তিনি বলছেন, “বিয়ে করার প্রস্তুতিটা এমনিতে মানসিক চাপের একটা সময়। ওই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের সাথে সে কিভাবে মানিয়ে নেবে, খাওয়া চলাফেরা করবে, ওখানে সে সবার সাথে মানাতে পারবে কিনা, তাকে সবাই কিভাবে ওয়েলকাম করবে, তার ভুল ত্রুটি মেনে নিয়ে তাকে সাপোর্ট করবে কিনা – সেগুলো তার উপর বিশেষ মানসিক চাপ তৈরি করে।”

“চারদিকে অনেক কিছু শুনতে পায় তারা। হয়ত বন্ধুর বিয়ে হয়েছে তার কাছেই তার অভিজ্ঞতা শুনে শঙ্কা কাজ করে। বিশেষ করে বৈবাহিক জীবনের যে বিশেষ দিকটা, যৌন সম্পর্ক সেখানে অনেক স্বামী সময় দিতে চান না। বিয়ের প্রথম বা কয়েক দিনের মধ্যেই জবরদস্তি করেন। অনেকেই মানসিকভাবে শক্ত হলে মানিয়ে নিতে পারেন। বাকিরা নানা মানসিক সমস্যায় পড়েন।”

নববধূদের সুরক্ষা দেয়া কতটা সম্ভব?

বাংলাদেশে সামাজিকভাবে বিয়ের পরে স্বামীর বাড়িই একজন নারীর মূল পরিবার হয়ে ওঠে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নীনা গোস্বামী বলছেন, “তাদের সুরক্ষার জন্য আইন রয়েছে কিন্তু সে নিজে যদি না জানে তাহলে সুরক্ষা দেয়া মুশকিল। একদম নতুন একটা জায়গায় গিয়ে সমস্যায় পরলে সে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে সেসব সে জানে না। এই কারণে সে আরও ঝুঁকিতে থাকে।”

তিনি আরও বলছেন, “এর বাইরে নতুন বিয়ের পর সমস্যা হলে সংসার টিকবে কীনা সেই কথা ভেবে আইনের কাছে যেতেও ভয় পান অনেকে। সংসার না টিকলে সমাজ আমাকে ভালো মেয়ে বলবে না এসব চিন্তাও কাজ করে।”

“শুধু সমাজ নয়, এমনকি নিজের বাবা মায়ের পরিবারের দিক থেকেও চাপ থাকে এমন ভালো মেয়ে হয়ে থাকার। শুধু রান্না আর সেলাই নয়, অভিযোগ না করার ব্যাপারেও শিখিয়ে পড়িয়ে তাদেরকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠানো হয়।”

আরএম-০৫/৩০/১০ (লাইফস্টাইল ডেস্ক, তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা)