এগিয়ে যেতে কি লাগে

এগিয়ে যেতে

অতিথি পাখি কীভাবে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয়? একটি বিমানকেও যেখানে মাঝে যাত্রা বিরতি করতে হয়, সেখানে সাগর মহাসাগর পেরিয়ে পাখিরা কীভাবে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলে? কখনো কি ভেবে দেখেছেন পাখিদের এ দীর্ঘ পথচলার শক্তির উৎস আসলে কী? জার্মানী ও অস্ট্রিয়ার একদল বিজ্ঞানী দীর্ঘপথ পরিভ্রমনকারী পাখির পথচলা পর্যবেক্ষণ করে জানিয়েছেন, পাখিরা এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয় ইংরেজি ‘ভি’ (v= victory) অক্ষরের মত করে; দলবদ্ধ হয়ে। সামনে যে পাখিটা থাকে, তার পাখার স্পদন সঞ্চারিত হয় পিছনের পাখিদের মধ্যে। এভাবে পুরো সারি’র কেউ যাতে ক্লান্তির কারণে দলছুট না হয়ে পড়ে, সেজন্য দু’জন করে স্থান পরিবর্তন করে। অনেকটা ম্যারাথনের রিলে দৌড়ের মত! ইংরেজি ‘ভি’ (v= victory) অক্ষরের মত পাখিদের পথ-পরিক্রমা বিশ্লেষণ করলে চারটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এগুলো হল নেতৃত্বগুণ বা Leadership, একতাবদ্ধ কাজ বা Teamwork, কর্মপ্রেরণা বা Motivation এবং গন্তব্যে পৌঁছানো বা Touching target.

আমাদের ক্যারিয়ারটাও কিন্তু দীর্ঘ পথের মত, জীবনব্যাপী রিলে দৌড়ের মত। কাঙ্খিত ক্যারিয়ারে পৌঁছানোর জন্যে দরকার হয় একতা, একাগ্রতা, গতিময়তা।

ভারসাম্য বজায় রেখে জীবনের গতিপথে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ভারতীয় লেখক, বক্তা ও জনপ্রিয় সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়টস’ এর কাহিনিকার চেতন ভগত বলেন ‘জীবনটা একটা মার্বেল দৌড়ের মত; স্কুলে যেমন চামচ মুখে দিয়ে মার্বেল দৌড়ে অংশ নেওয়া হয়’।

ক্যারিয়ারের এই রিলে দৌড়ে টিকে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য দরকার নিজস্ব তাড়না ও অন্যের প্রেরণা। ব্রুস লির এক ছাত্র প্রতিদিন তাঁর সঙ্গে তিন মাইল দৌড়াতেন। একদিন তিন মাইল পথ ছোঁয়ার পথে ব্রুস লি বললেন, চলো আরও দুই মাইল দৌড়াই। তাঁর ছাত্র ক্লান্ত হয়ে পড়ে বললেন, আরও দুই মাইল দৌড়াতে গেলে আমি মারা যাব। ব্রুসলি বললেন, তবে দৌড়াও। তাঁর সেই ছাত্র রেগে গিয়ে আরও পাঁচ মাইলের সীমা অতিক্রম করে ফেলল। খেপে গিয়ে ওই মন্তব্য নিয়ে ব্রুস লির কাছে জবাব চাইলেন ওই ছাত্র। ব্রুস লি তাঁকে বোঝালেন, ‘থেমে যেতে বা মরে যেতে পারতে। কিন্তু যদি তুমি যা পারো, সেখানেই তোমার সীমা নির্ধারণ করে ফেলো, তবে তা সারা জীবনে তোমার ওপর প্রভাব ফেলবে। এটা তোমার কাজে, নৈতিকতাসহ সবকিছুতে ছড়িয়ে যাবে। সীমা বলে কিছু নেই। স্থিরতা আছে, কিন্তু সেখানে থেমে গেলে চলবে না। মানুষকে অবশ্যই তাঁর সীমা ক্রমাগত ছাড়িয়ে যেতে হবে।’

সবারই সীমাবদ্ধতা আছে সত্যি। তবে সীমাটা নির্ধারিত হয় নিজের মস্তিস্কের মধ্যে; মনোজগতে। সফল কারও কথা আলোচনা হলে কেউ কেউ বলে বসেন যে ওর ‘মাথা’ ভালো! আসলে সফল হওয়ার সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার সম্পর্কের বিষয়টি নিসন্দেহে যুক্ত! তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বলছেন ভিন্ন কথা।

মনোবিদ ক্যারোল ডোয়েক এর গবেষণা অনুযায়ী, সফল হওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের বুদ্ধিমত্তার চেয়ে তার আচরণ ভালো পূর্বাভাস দিতে পারে। তাঁর মতে, মানুষের মূল আচরণকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে স্থায়ী মানসিকতা (ফিক্সড মাইন্ডসেট) ও আরেকটি হচ্ছে বিকাশমান মানসিকতা (গ্রোথ মাইন্ডসেট)।

স্থায়ী বা অবিচল মানসিকতা হচ্ছে যখন কেউ নিজের সম্পর্কে ধরে নেয় যে সে যা তা–ই। সুবিধাজনক জায়গায় (Comfort Zone) থাকতে চায় তার মন। কোনো পরিবর্তন তাঁর মধ্যে আনা অসম্ভব মনে করে। যখন তাঁকে চ্যালেঞ্জ করা হয়, তখনই সমস্যা সৃষ্টি হয়। এরকম পরিস্থিতিতে সে হতাশ ও বিহ্বল হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই একগুয়েমি ভাবকে আকাঙ্খা দারিদ্র্য (Poverty of Aspiaration) বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা নিজেদের বিকাশমান মানসিকতার ব্যক্তি মনে করেন, বিশ্বাস করেন চেষ্টা করলে তিনি উন্নতি করতে পারবেন। তারা বিভিন্ন দিক থেকে স্থায়ী মানসিকতার ব্যক্তিদের ছাড়িয়ে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। এমনকি বুদ্ধিমত্তা বা আইকিউ কম থাকলেও প্রচেষ্টার কারণে এগিয়ে যেতে পারবেন। যেকোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলে অন্তত নতুন কিছু শেখার সুযোগ তৈরি হয় তাই তারা কোনো না কোন ভাবে এগিয়ে যান। জীবনের সিদ্ধান্ত নির্ণয় করার ক্ষেত্রে কীভাবে বিপত্তি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবেন তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিকাশমান মানসিকতার ব্যক্তিরা এসব বিপত্তি খোলামনে স্বাগত জানান। গবেষক ডোয়েকের মতে, জীবনে সফলতা হচ্ছে ব্যর্থতা কীভাবে মোকাবিলা করা হয় সে বিষয়টি বোঝা। বিকাশমান মানসিকতার মানুষ এভাবেই ব্যর্থতাকে গ্রহণ করে। তাঁদের কাছে ব্যর্থতা হলো তথ্য। এটাকে ব্যর্থতা হিসেবে লেবেল লাগানো হয় মাত্র। বিকাশমান মানসিকতার ব্যক্তির কাছে সমস্যা সমাধানের ভিন্ন পথে যাওয়ার আরেকটি সুযোগ।

অপরাহ উইনফ্রে বাল্টিমোরে অতিরিক্ত আবেগ দেখানোর কারনে টিভি উপস্থাপিকার চাকরি হারিয়েছিলেন অথচ উপস্থাপনা করে তিনি যশ, খ্যাতি, অর্থ অর্জনে অনন্য হয়ে আছেন।

দুটি গাড়ি কোম্পানি ব্যর্থ হয়েছিল হেনরি ফোর্ডের! তার পরের গল্প সবার জানা।

উএসসির সিনেমাটিক আর্টস স্কুল থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গ অথচ সিনেমা জগতে নৈপথ্যের নায়ক হিসেবে তিনি সুপরিচিত।

স্টিভ জবস নিজের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি থেকে চাকরিচ্যুত হয়েই গড়ে তুলেছেন ‘প্রিক্সার’ এর প্রতিষ্ঠান।

তাঁরা যদি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর নতুন আশা নিয়ে ঘুরে না দাঁড়াতেন, তবে কি সফল হতে পারতেন?

আপনার জীবনেও কঠিন সময় আসতেই পারে। তাই বলে নিজেকে পুরোপুরি অসহায় ভাববেন না। অসহায়ত্বের অনুভূতিতে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এটা থেকে কিছু শিখতে পারেন এবং সামনে এগিয়ে যেতে পারেন। বুদ্ধিতে আপনার ঘাটতি থাকলে তা আবেগ দিয়ে পূরণ করতে পারেন। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ওয়ারেন বাফেটের পরামর্শ হচ্ছে আপনার সত্যিকারের আবেগের বিষয়টি ৫/২৫ পদ্ধতিতে খুঁজে বের করতে পারেন। এ পদ্ধতিতে আপনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব ২৫টি বিষয় লিখবেন ২০টি বিষয় বাদ দেবেন। যে ৫টিকে আপনি রাখবেন তাই আপনার প্রকৃত আবেগ। বাকিগুলো আপনার চিত্তবিক্ষেপ বা আবেগের অতিশায়ন। তাই আবেগ থেকে যদি বেগ আসে মন্দ কি?

আরএম-২৯/১৯/০১ (লাইফস্টাইল ডেস্ক)