যৌন হয়রানিবিরোধী কমিটির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন

নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যার প্রেক্ষাপটে ১০ বছর আগে আদালতের একটি নির্দেশনার বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)৷ নির্দেশনা অনুযায়ী সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি করতে হবে৷

তবে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ এবং কোনো ঘটনা ঘটার পর তড়িঘড়ি করার সংস্কৃতির কারণে এবারের সরকারি উদ্যোগ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে৷

‘‘কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমরা একটা তৎপরতা দেখি৷ এবারও নুসরাতের ঘটনার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে, যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি করতে হবে৷ এই কমিটি হচ্ছে কি-না, তারা ঠিকমতো কাজ করছে কি-না– এসব নিয়ে কোনো ধরনের মনিটরিং নেই৷ শুধু দায় এড়াতে পরিপত্র জারি করলে তো হবে না,” বলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন।

তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি, এখানে সরকারের গাফিলতির ব্যাপার আছে৷ এখানে সরকারকেই আন্তরিক হতে হবে৷ বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে৷ তারা উদ্যোগী হলে এই ধরনের ঘটনা কমে আসবে৷”

যেই রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে হাই কোর্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে নীতিমালা করে দিয়েছিল, সেই রিটকারীদের পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন ব্যারিস্টার সারা৷

আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় নানা দিক থেকে যৌন হয়রানি সরকারের স্বদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে৷ এর মধ্যে কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি হলেও বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ নেয়নি৷ আর স্কুল-কলেজগুলোতে ওই কমিটি নেই৷

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো হেনস্তার শিকার হন৷ এরপর নিপীড়ক অধ্যক্ষের নির্দেশে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে৷ ওই ঘটনার পর আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি গড়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে৷

এরপর বৃহস্পতিবার জারি করা একটি পরিপত্র সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয় মাউশি৷ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা ওই পরিপত্রে বলা হয়, ‘‘মহামান্য হাই কোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং এর আওতাধীন অফিস ও দেশের সকল সরকারি/বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন এবং প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করে৷

এ আদেশ মোতাবেক প্রতিটি অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করবে৷ প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি কমিটি গঠন করে তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে৷”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৮ সালে প্রথম যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা ও আইন করার দাবি উঠেছিল৷ ওই সময় ছাত্র-শিক্ষকরা মিলে একটি নীতিমালার একটি খসড়া জমা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে৷ এরপর বিভিন্ন সময়ে নারী নির্যাতনের ঘটনায় নানা জায়গা থেকে একই দাবি আসতে থাকে৷

দীর্ঘ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিকনির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তখনকার নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী৷ এরপর ২০০৯ সালের ১৪ মে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ মাহমুদ হোসেন (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ কর্মেক্ষেত্রে ও শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি দিকনির্দেশনামূলক রায় দেন৷

সেই দিকনির্দেশনার পাশাপাশি কেন নতুন আইন বা বিধিমালা প্রণয়ন করতে নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানাতে সরকারের প্রতি রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট৷

১০ বছরেও ২০০৯ সালের আদেশের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশার কথা জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক৷ তিনি বলেন, ‘‘আদালতের এমন চমৎকার আদেশ থাকার পরও এটার বাস্তবায়ন হচ্ছে না, অথচ এই কমিটিগুলো তৈরি করে সচল করা গেলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি অনেকাংশেই বন্ধ করা যেতো৷”

মাদ্রাসাগুলোতে যৌন হয়রানি ঠেকাতে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের উদ্যোগ না থাকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘‘সমস্যা হচ্ছে মাদ্রাসা৷ সেখানে মাদ্রাসা বোর্ড আছে, তারা কঠোর হলেই আজ নুসরাতকে জীবন দিতে হতো না৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবস্থা আরো খারাপ৷ উচ্চ আদালতের আদেশ তো আইন, সরকারের উচিত যাতে সেটা সবাই মান্য করে, সে ব্যাপারে ব্যাবস্থা নেওয়া৷”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সদস্য অধ্যাপক সাদেকা হালিমও আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিথিলতার সমালোচনা করেন৷ ‘‘আদালতের আদেশ আছে, কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই তো এটা মানছে না৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইলে তো উদ্যোগ নিতে পারে৷ কিন্তু তারাও কিছু করছে না,” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক৷

‘‘আর মাদ্রাসা তো নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠান, সেখানে চাইলেই বাইরের কেউ ঢুকতে পারেন না৷ ফলে সেখানে কী হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা কতটুকু নিরাপদ, সেটা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই৷ এখন একটা ঘটনা ঘটে গেছে, সবাই এটা নিয়ে কথা বলছে৷ আসলে আমাদের মূল জায়গাটা হলো আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করতে হবে৷ সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ই হোক আর স্কুলই হোক৷”

এসএইচ-০৫/২৩/১৯ (সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে)