জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর রহিঙ্গা ইস্যু প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেছে!

দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭শে সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য রাখার কথা রয়েছে।

গত দুবছরই জাতিসংঘে শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যে প্রাধাণ্য পেয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যু।

২০১৭ সালের অগাস্টের শেষ দিকে বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যা, নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেন।

বর্তমানে ১১ লক্ষের মত রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে রয়েছে।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বক্তব্য রাখার সময় অন্যান্য বিষয়ের সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরেন। সেই পাঁচটি প্রস্তাব গুলো হল:

১.অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা।

২. অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা।

৩. জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় (safe zones) গড়ে তোলা।

৪. রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা।

৫. কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

২০১৮ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক বৈশ্বিক প্রভাব শীর্ষক এক বৈঠকে তিনি আরো তিনটি সুপারিশ করেন। সুপারিশ গুলো হল:

১ . মিয়ানমারকে অবশ্যই বৈষম্যমূলক আইন ও নীতি বিলোপ, এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ ও তাদের সে দেশ থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে হবে।

২. মিয়ানমারকে অবশ্যই সকল রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব প্রদানের সঠিক উপায়, নিরাপত্তা নিশ্চিত ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রয়োজনে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় মিয়ানমারের ভেতরে ‘সেফ জোন’ তৈরি করতে হবে।

৩. মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৈরাজ্য রোধে অপরাধীদের জবাবদিহিতা, বিচার, বিশেষ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশমালার আলোকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

এখন দুই দফায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সুপারিশ গুলো বাস্তবায়নের পথে কতটা এগিয়েছে?

কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় রয়েছে যারা মূলত রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ও প্রত্যাবাসনের কাজ করছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে যারা প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব এবং রোহিঙ্গা ইস্যু পর্যবেক্ষণ করছেন তারা এসব প্রস্তাবের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু তথ্য জানাচ্ছেন।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হূমায়ূন কবির বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তাব গুলো দিয়েছেন সেগুলো কিছু কিছু বিভিন্নভাবে হয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গভাবে কোনটাই সফল হয় নি।

কবির বলছিলেন “আন্তর্জাতিক মহলের মধ্যে সকলেই যদি সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে তাহলে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব”

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলতে তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের যে ৫টি সদস্য দেশ রয়েছে তাদের কথা বলেছেন।

তিনি বলছিলেন “তাদের মধ্যে একটা ঐক্যমত্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। যেহেতু সেই ঐক্যমত্যের জায়গা তৈরি হয়নি তাই এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারিনি”।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান।

তিনি বলছিলেন “মিয়ানমারের ভিতরে সেফ জোন তৈরি করা বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সেই ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আমরা যে তথ্য পাচ্ছি তার কোন নিশ্চয়তা দেখছি না”।

তবে বিচারের বিষয়ে যে সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন তার কিছুটা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন মি. খান।

তিনি মনে করেন ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের মাধ্যমে দালিলিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, যেটা কাজে লাগবে।

ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের পর একটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেশন মেকানিজম তৈরি করা হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে।

সম্প্রতি তারা একটা রির্পোট তৈরি করেছেন। সেখানে তারা কিছু সুপারিশমালা তৈরি করেছেন।

কবির বলছেন “যে জায়গাগুলোতে সফলতা অর্জন করা গেছে সেজায়গাগুলো মূলত দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিপাক্ষিক পর্যায়ে রয়েছে”।

জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনে চীন,বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে একটা ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে।

তারা তদারকি করবে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কতটা অগ্রসর হল কি হল না।

কবির ‘এই ফোরামের থিউরিটিক্যাল বা তাত্ত্বিক মুভমেন্ট লক্ষ্য করছেন’ বলে উল্লেখ করেন।

ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেশন মেকানিজম মিয়ানমারে কী কী অপরাধ হয়েছে বা হয়নি সেগুলো মূল্যায়ন করে তারা একটা সিদ্ধান্তের জায়গায় পৌঁছেছে যে মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, মানবতা-বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

এবং একটা জনগোষ্ঠীকে উৎখাতের জন্য বলপ্রয়োগ করা হয়েছে।

ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেশন মেকানিজম বলেছে এই ডকুমেন্ট বা তথ্যগুলো জাতিসংঘে সংরক্ষিত থাকবে।

যদি কখনো ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে (আইসিসি) মিয়ানমারের যারা এই অপরাধ করেছে তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তাহলে তাদের অপরাধকে প্রমাণ করার জন্য সাক্ষী হিসেবে এই তথ্যগুলো ব্যবহার করা যাবে।

যদিও মিয়ানমার বলছে যে তারা কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করছে কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, পর্যবেক্ষক এবং রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের উপর সেই ভরসা পাচ্ছে না।

“কারণ তারা যে কথা বলছে এবং কাজ করছে তার মধ্যে অনেক ফারাক রয়েছে” বলে মন্তব্য করেন মি. কবির।

খান বলছিলেন, কফি আনান কমিশন একটা প্রতিবেদন দিয়েছে এটাই একটা অগ্রগতি। এছাড়া দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই।

“তবে এই রিপোর্ট ধরে ধরে কোন কিছুরই অগ্রগতি হচ্ছে না। কেবল মাত্র বিচারের ক্ষেত্রে তথ্য অনুসন্ধান, দালিলিক প্রমাণ , সাক্ষ্য গ্রহণ এই কাজটি এগুচ্ছে এর বাইরে এখন পর্যন্ত কোন অগ্রগতি নেই” বলছিলেন মি.খান।

বাংলাদেশ দুইবার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করে।

কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি হয় নি বরং কয়েকটি দফা তারা তুলে ধরে যেগুলো পূরণ না হলে তারা ফেরত যাবে না বলে জানিয়েছে অগাস্টে টেকনাফের উখিয়াতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করা এক সমাবেশে।

খান বলছিলেন “রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য যে পরিবেশ তৈরি করা দরকার , যে আইনি স্বীকৃতি থাকা দরকার সে বিষয়ে কার্যকর কোন পদক্ষেপ মিয়ানমারের তরফ থেকে দেখা যায় নি”।

“রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য মিয়ানমারকে সব করতে হবে এখানে বাংলাদেশের কিছু করার নেই। আন্তর্জাতিক মহলকে সাথে নিয়ে মিয়ানমারের উপর চাপ তৈরি করা, যাতে আন্তর্জাতিক মহলের চাপে মিয়ানমার এই জায়গাগুলোতে পদক্ষেপ গ্রহণ করে” বলছিলেন মি. খান।

তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে দুই দফা যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে করে তিনি আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন।

জনমত গঠনে এটা ভূমিকা রেখেছে। তবে যে মাত্রায় মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করা দরকার সেই মাত্রায় আন্তর্জাতিক মহল অংশ নিতে পারেনি, বলছেন পর্যবেক্ষকরা।

এসএইচ-০৪/২৭/১৯ (ফারহানা পারভীন, বিবিসি)